নিজস্ব সংবাদদাতা,সুনামগঞ্জ
প্রয়োজনীয়সংখ্যক ডাক্তার নাই, নার্স নাই; নাই কর্মচারি-আয়া-ক্লিনার, হাওর অধ্যুষিত প্রান্তিক একটি জনপদের প্রধান চিকিৎসালয় সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতাল জনবলের এমন সঙ্কটে ধুঁকছে দীর্ঘদিন ধরে। উদ্ভুত সঙ্কটের কারণে বছরের পর বছর ধরে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ।
আটতলা বিশিষ্ট ২৫০ শয্যার মনোরম ভবন নির্মাণ হয়েছে ঠিকই কিন্তু সেবাদানের জন্য জনবল নাই। ত্রিশ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত হাওর জেলা সদর হাসপাতালে নাই আইসিইউ-সিসিইউ ইউনিট। ফলে জটিল রোগীদের সিলেটে নেওয়া ছাড়া কোন বিকল্প নেই। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা এসব রোগীদের জীবন হাতে নিয়েই পাড়ি দিতে হয় ৬৭ কিলোমিটার পথ। পথিমধ্যে অহরহ অকালে ঝরে অনেক প্রাণ।
হাসপাতাল ভবনের ভেতরে আইসিইউ ও সিসিইউয়ের জন্য নির্ধারিত স্থান থাকলেও সরঞ্জামি ও জনবল না থাকায় সব সময় থাকে তালাবদ্ধ। উল্লেখিত দুটি ইউনিটে ৬ শয্যার আইসিইউ ও ৮ শয্যার সিসিইউ থাকার কথা। ইউনিট দুটি পরিচালনার জন্য ডাক্তার, নার্সসহ নেই অভিজ্ঞ জনবল। নিজস্ব অক্সিজেন প্ল্যান্ট না থাকায় বড় সিলিন্ডারের চলছে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সেবার কার্যক্রম। দক্ষ ও প্রয়োজনীয় জনবল সঙ্কটের কারণে সব ধরনের সেবা দেয়া যাচ্ছে না বলে দাবি করছেন কর্তৃপক্ষ।
এদিকে, জেলায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত ৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ৫০ শয্যার করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছে করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য। দেওয়া হয়েছে, প্রয়োজনীয়সংখ্যক ডাক্তার-নার্স। তবে হাই-ফ্লু অক্সিজেনের ব্যবস্থা না থাকায় হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নেওয়া রোগীর সংখ্যা কম।সদর হাসপাতালের পুরাতন ভবনে ৫০ শয্যার করোনা রোগীদের সেবা দেয়া হচ্ছে। আক্রান্ত রোগীদের অক্সিজেনের প্রয়োজন হলে সাধারণ অক্সিজেন সিলিন্ডারের মাধ্যমে অক্সিজেন সেবা দেয়া হচ্ছে। রোগীর অবস্থার অবনতি হলে কাজে আসছে না এসব সাধারণ অক্সিজেন সিলিন্ডার। ফলে বাধ্য হয়ে উন্নত সেবা পেতে সিলেট যেতে হচ্ছে রোগীদের।
রোগীদের সেবা দিতে সরকার দুটি মূল্যবান এক্স-রে মেশিন সরবরাহ করলেও রেডিওলজিস্ট ও রেডিওগ্রাফার না থাকায় টানা প্রায় চার বছর ধরে সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা। যে কোন ধরনের এক্সরে করতে রোগীদের বাধ্য হয়ে যেতে হচ্ছে প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। এতে গরীব অসহায় রোগীরা পড়েন মারাত্মক দুর্ভোগে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নতুন সু-উচ্চ ভবনে সুনামগঞ্জ ২৫০ শয্যা হাসপাতাল চালু হলেও বাস্তবে শয্যা অনুপাতে বাড়েনি জনবল।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, এ হাসপাতালটিতে রয়েছে মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি, শিশু, নবজাতক, ডায়রিয়া ও ডায়ালাইসিস ওয়ার্ড। সবগুলো বিভাগ চালাতে ৫৯ জন ডাক্তারের পদ রয়েছে। তার মধ্যে ১০ জন বিশেষজ্ঞ, একজন আবাসিক চিকিৎসক ও দুইজন মেডিকেল অফিসার মিলিয়ে হাসপাতালটিতে বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র ১৬ জন ডাক্তার। হাসপাতালের কার্ডিওলজিস্ট ডা. মোহাম্মদ হোসেন ছুটি নিয়ে গত এক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করায় হৃদরোগের যাবতীয় চিকিৎসা বন্ধ রয়েছে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে।
আর নার্স, আয়া, পরিচ্ছন্নতাকর্মীর বেশিরভাগ পদও শূন্য হাসপাতালটিতে। ২২৩ জন নার্সের মঞ্জুরিকৃত পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ১১৮ জন। আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন থাকায় মাত্র চারজন কর্মরত আছেন বর্তমানে। ৩৯তম বিসিএস উত্তীর্ণ ১২ জন ডাক্তার নিয়োগ দেওয়া হলেও বিশেষায়িত করোনা ইউনিটে তারা বিশেষায়িত কর্মরত রয়েছেন।
কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রান্তিক জেলা হওয়ায় ডাক্তাররা এখানে এসে থাকতে চান না। বদলির আদেশ তামিল হওয়ার আগেই তদবির করে সেটা স্থগিত করে দেন অনেকেই। ফলে শূন্য হাসপাতাল শূন্যই থেকে যায়। এদিকে, ‘নাই’ এর আছর কাটাতে স্থানীয় ও আশপাশের জেলা থেকে ডাক্তার নিয়োগে দেওয়ার বিষয়টি অগ্রাধিকার দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
সূত্র জানায়, সদর হাসপাতালে জরুরি বিভাগের চার জন ডাক্তারের সবগুলো পদই এখন শূন্য। প্রেষণে ডাক্তার এনে জোড়াতালি দিয়ে চালানো হচ্ছে জরুরি বিভাগ।
হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স ও জনবল সংকট দূরীকরণে আমরা কর্তৃপক্ষকে জানাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, আমাদের পাশপাশি সদর আসনের সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ এ নিয়ে সংসদে শোচ্চার রয়েছেন। সাম্প্রতিক বাজেট বক্তৃতায় তিনি বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরেছেন।
হাসপাতালের সার্বিক অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, লিখে কী হবে। গত ৫ বছর ধরে দেখে আসছি জনবল সংকট নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীরা লিখছেন, সংশ্লিষ্টরা কর্তৃপক্ষকে নিয়মিত রিপোর্ট করছেন; পরিবর্তন তো কিছুই হচ্ছে না। তাঁর মতে, প্রান্তিক জেলা হওয়ায় এখানে এসে ভাল কোন ডাক্তার থাকতেই চান না। অনেকই মাঝপথে বদলির আদেশ স্থগিত করে দিয়ে পুরনো কর্মস্থলে থেকে যান। কেউ কেউ নানা বাহানায় ছুটি নিয়ে বছরের পর বছর কাটিয়ে দেন। তাঁর মতে, সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের শনির দশা কাটাতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যদি বিশেষ নজর দেন তবেই এই অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব।
এমনতর সঙ্কট নিরসেন কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. মো. আনিসুর রহমান। তিনি জানান, ১০ শয্যার আইসিইউ এবং নিজস্ব অক্সিজেন প্ল্যান্ট নির্মাণে কাজ চলছে। হাসপাতালের পুরনো ভবনে আইউসিইউ ইউনিট এবং অক্সিজেন প্ল্যান্ট নির্মাণের কাজ প্রক্রিয়াধীন। দু’টি প্রতিষ্ঠান পৃথক ভাবে এ নিয়ে কাজ করছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে কাজ দু’টি সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে তা কিছুটা বিলম্বিত হচ্ছে। তিনি বলেন, স্থানীয় এমপির নির্দেশনায় হাসপাতাল ম্যানেজমেন্ট কমিটির উদ্যোগে এক্সরে চালানোর জন্য অস্থায়ী ভিত্তিতে একজন টেকনিশিয়ান নিয়োগ দিয়ে ২১জুন থেকে হাসপাতালের এক্সরে মেশিনটি চালু করা হয়েছে।
জনবল সঙ্কটের কথা স্বীকার করে সি ভিল সার্জন ডা. শামস উদ্দিন বলেন, আমরা আমাদের অবস্থান থেকে যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। জনবলের সঙ্কট মেটানোর জন্য সকল সেক্টর থেকে কর্তৃপক্ষকে তাগিদ দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, হাসপাতালের সার্বিক উন্নয়নে আমরা নিরলসভাবে কাজ করছি। করোনা রোগীদের যথাযথ চিকিৎসা দিতে আমরা সতর্কতার সাথে কাজ করছি। এখানে আইসিইউ এর ব্যবস্থা না থাকায় জটিল রোগীদের আমরা দ্রুততার সাথে সিলেট শামসুদ্দিন হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়ে থাকি। আমাদের এখানে আইসিইউ চালু হয়ে গেলে করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য অন্যত্র পাঠানোর দরকার পড়বে না। সুনামগঞ্জে এখন পর্যন্ত করোনা পরিস্থিতি অনেকটা সহনীয় মাত্রায় রয়েছে বলেও জানান তিনি।
সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি : নূরুর রশীদ চৌধুরী, সম্পাদক : ফাহমীদা রশীদ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক : ফাহমীনা নাহাস
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : অপূর্ব শর্মা