বিন্দু তালুকদার, সুনামগঞ্জ :::
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম টি-টোয়েন্টিতে ২৩ রানের জয়ের নায়ক নাসুম আহমেদ। সেই ম্যাচে ৪ উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা হন নাসুম আহমেদ। চলতি বছরের মার্চে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখেন নাসুম আহমেদ।
জাতীয় দলের জার্সিতে দারুণ পারফরম্যান্স করা তারকা ক্রিকেটার নাসুম আহমেদের গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া ইউনিয়নের মধুরাপুর (মর্দাপুর)। নাসুম আহমেদ সোমবার রাতে নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে ‘আমার জন্ম, বড় হওয়া, পড়ালেখা কিংবা ক্রিকেট খেলা, সবকিছুই সিলেটে। আমার বাবার জন্মও সিলেটে। একসময় আমার দাদাবাড়ি সুনামগঞ্জ জেলায় ছিল। কিন্তু আমার দাদা ১৯৫৮ সালে সিলেটে স্থায়ীভাবে চলে আসেন। ছোটবেলা সুনামগঞ্জে একবার গিয়েছিলাম এবং রাস্তাঘাটও ঠিকভাবে চিনি না ওখানকার। পরবর্তীতে ওখানকার একটা টুর্নামেন্টে একবার ‘খ্যাপ’ খেলতে গিয়েছিলাম। ’
তিনি আরও লিখেন, ‘সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদে হয়তো অনেকে বিভ্রান্ত হয়েছেন আমি আমার জেলা দলে নিষিদ্ধ। কিন্তু আমি যে জেলার হয়ে কখনো খেলিনি তারা আমাকে কীভাবে নিষিদ্ধ করে ? ২০০৫ সালে ১১ বছর বয়সে আমি পেশাগতভাবে ক্রিকেট শুরু করি এবং ওই বছর জেলা ক্রিকেটে সুনামগঞ্জের কোনো দলই ছিল না। তখন থেকে সবসময়ই সিলেটের হয়ে খেলেছি। সিলেট লীগে খেলেছি ২০০৬ সাল থেকে এবং সিলেট জেলা দলে খেলেছি ৩ বছর, আর বিভাগীয় দলে ২০১০ সাল থেকে। আল্লাহ্র অশেষ রহমতে আমি বাংলাদেশ দলে সুযোগ পেয়েছি এবং ভবিষ্যতে আরও এগিয়ে যেতে সবার দু’য়া কামনা করি।’
নাসুমের ফেসবুক মন্তব্যে ক্ষুব্দ হয়েছেন সনামগঞ্জের লোকজন। দেশে ও বিদেশে সুনামগঞ্জের বাসিন্দারা ফেসবুকে ব্যাপক ট্রল করেছে তাকে। নাসুমের ফেসবুক পেজের স্কিনসট, সুনামগঞ্জ জেলা ক্রিড়া সংস্থার ক্রিকেট বিভাগের নিবন্ধন ফরম ও জন্ম নিবন্ধন সনদের কপি সুনামগঞ্জ তথা সিলেট এলাকায় ভাইরাল হয়েছে।
জানা যায়, ক্রিকেটার নাসুম আহমেদের গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া ইউনিয়নের মধুরাপুর গ্রামে। বাবা আক্কাস আলী ও মা শিরিয়া বেগম প্রায় ৩০ বছর আগেই জীবিকার তাগিদে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে সিলেটে চলে গিয়েছিলেন। বর্তমানে সেখানেই তাদের বসবাস। নিম্নবিত্ত পরিবারের ক্রিকেট পাগল নাসুম ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করে আর স্কুলে যায় নি। পরে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়ে কিছু পড়াশুনা করেন। সারাদিনই ক্রিকেট নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন নাসুম। ২০০৯ সাল থেকে সুনামগঞ্জের প্যারামাউন্ট ক্রিকেট ক্লাব এবং সিলেটে আরেকটি ক্রিকেট ক্লাবে খেলতেন তিনি।
২০১৩ সালে সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলা দলের হয়ে ম্যাচ খেলার আমন্ত্রণ পায় নাসুম। সে সময় তিনি সুনামগঞ্জের হয়ে না খেলে সিলেট জেলা দলের হয়ে খেলেন। যার কারণে ওই সময় তাকে আজীবন নিষিদ্ধ করে সুনামগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থা।
সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম টি-টোয়েন্টিতে নাসুমের নৈপুণ্যতা দেখার পর নাসুম সুনামগঞ্জে আজীবন নিষিদ্ধ থাকার বিষয়টি প্রকাশ হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসুবকে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। এবং তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবি জোরালো হয়। স্থানীয় ক্রিকেটারগণও নাসুমের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করার পক্ষে সহমত পোষণ করেন।
কিন্তু ১৬ আগস্ট সোমবার রাতে নাসুম আহমেদ নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজের স্কিনসট সোমবার রাতেই ভাইরাল হয়। এরপর মঙ্গলবার সুনামগঞ্জ জেলা ক্রিড়া সংস্থার ক্রিকেট বিভাগের নিবন্ধন ফরম ও নাসুমের জন্মনিবন্ধন সনদ ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসুবকে দেশ-বিদেশে তোপের মুখে পড়েছেন নাসুম।
মঙ্গলবার সুনামগঞ্জ জেলা ক্রিড়া সংস্থার অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১০ সালে সুনামগঞ্জ জেলা ক্রিড়া সংস্থার ক্রিকেট বিভাগের নিবন্ধন ফরমে নাসুম নিজেকে প্যারামাউন্ট ক্রিকেটক্লাবের সদস্য হিসেবে দিরাইয়ের মথুরাপার (মর্দাপুর) গ্রামের স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ করেছেন। স্থায়ী ঠিকানার জন্মনিবন্ধন সনদও জমা দিয়েছেন তিনি। প্যারামাউন্ড ক্রিকেট ক্লাবের সদস্য হিসেবে সুনামগঞ্জে জেলা স্ট্রেডিয়ামে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগের খেলার সকল পারফরম্যান্স স্কোরবুক কপিতে লিপিবদ্ধ আছে।
দিরাইয়ের বাসিন্দা একে কুদরত পাশা বলেন,‘ নাসুম তার নৈপুণ্যতা দিয়ে জাতীয় দলের ক্রিকেটার হিসেবে দেশের সম্মান বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু তার ফেসবুক পেজের স্ট্যাটাসে আমরা আহত হয়েছি। আমরা আশা করব, তিনি এই মন্তব্য প্রত্যাহার করবেন।’
সুনামগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থার ক্রিকেট বিভাগের যুগ্ম সম্পাদক চৌধুরী আহমেদ মুজতবা রাজি বলেন,‘ সোমবার রাতে নাসুম ফেসবুক পেজে স্ট্যাটাস দিয়ে বলেছে, সে সুনামগঞ্জে কখনই আসেনি, খেলেনি। বয়ষ ভিত্তিক বা জেলা দলে সে খেলেনি সত্য। কিন্তু সে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগে প্যারামাউন্ট ক্রিকেট ক্লাবের পক্ষে খেলেছে। জেলা ক্রিড়া সংস্থার ক্রিকেট বিভাগের নিবন্ধন ফরম ও জন্ম নিবন্ধন সনদ অনুযায়ী সুনামগঞ্জের বাসিন্দা। বর্তমানে নাসুম কিসের ভিত্তিতে সুনামগঞ্জের সাথে তার সম্পর্ক নেই বলছে, এর ব্যাখা নাসুমই দিতে পারবে।’
সুনামগঞ্জ জেলা আম্পায়ার এন্ড স্কোরার এসোসিয়েশনের সহ সভাপতি জিএম তাশহিজ বলেন,‘ নাসুম দিরাই উপজেলার মথুরাপুর গ্রামের বাসিন্দা, এটা পুরো জেলার মানুষ জানে। এই হিসেবে সে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগে খেলেছে। এখন সে ফেসবুকে বিভ্রান্তকর কথা বলেছে। এটা ঠিক হয়নি। কারণ সে সুনামগঞ্জের বাসিন্দা না হলে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগে খেলেছে কিভাবে ?
তবে নাসুম আহমেদ মঙ্গলবার বিকালে মুঠোফোনে এ প্রতিবেদককে বলেছেন,‘ আমি সুনামগঞ্জের বাসিন্দা নই, সিলেটের বাসিন্দা। আমার ও আমার বাবার সবকিছুই সিলেটে। বিষয়টি নিয়ে ভুল বুঝাবুঝি হচ্ছে। প্যারামাউন্ট ক্রিকেট ক্লাবের সভাপতি উজ্জ্বল ভাইয়ের অনুরোধে আমি সে সময় সুনামগঞ্জে শর্তসাপেক্ষ খ্যাপ খেলেছি। আমি তখনই বলেছি আমি সুনামগঞ্জের জেলা দলের পক্ষে খেলতে পারব না।’
তিনি আরও বলেন,‘ যে কোন মাঠে খেললে একটি ফরমে স্বাক্ষর করতে হয়। তাই আমি ফরমে স্বাক্ষর করেছি। তবে জন্ম নিবন্ধন সনদের কপির বিষয়ে আমি কিছুই জানি না, এসব ভুয়া। কারণ আমার পাসপোর্ট সিলেটের ঠিকানা দেওয়া আছে। ’
এদিকে প্যারামাউন্ট ক্রিকেট ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. এনাম আহমদ বলেছেন,‘ নাসুম সুনমাগঞ্জের বাসিন্দা হিসেবেই তাদের ক্লাবে ক্রিকেট লীগ খেলছে। ফেসবুক পোস্টটি তাদের নজরে পড়েছে। বিষয়টি নিয়ে নাসুমের সাথে কথা বলবেন তিনি। ’
সুনামগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান ইমদাদ রেজা চৌধুরী বললেন,‘ নাসুম দিরাইয়ের মথুরাপুরের বাসিন্দা হিসেবে ২০১০ সালে সুনামগঞ্জের খেলোয়ার হিসেবে খেলেছে। ২০১৩ সালে জেলা টিমের জন্য যখন ডাকা হয় তখন আসেনি। অন্য জেলার টিমে খেলেছে। সেজন্য তাকে শোকজ করা হয়। কিন্ত শোকজের জবাব দেন নি। এজন্য ক্রিকেট কমিটি তাকে শুধুমাত্র সুনামগঞ্জের জন্য বহিস্কার করেছে।’
সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি : নূরুর রশীদ চৌধুরী, সম্পাদক : ফাহমীদা রশীদ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক : ফাহমীনা নাহাস
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : অপূর্ব শর্মা