• ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ১১ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

টাঙ্গুয়ার হাওরে নৌকা ভাড়া বৃদ্ধি করায় পর্যটকদের ক্ষোভ

Daily Jugabheri
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ৭, ২০২১
টাঙ্গুয়ার হাওরে নৌকা ভাড়া বৃদ্ধি করায় পর্যটকদের ক্ষোভ

বিন্দু তালুকদার, সুনামগঞ্জ
মেঘালয় পাহাড়ের কোলঘেষা বিশাল জলরাশির টাঙ্গুয়ার হাওর। জল-জ্যোৎ¯œা ও হাওর-পাহাড়ের সুনামগঞ্জে আসা পর্যটকদের মূল আকর্ষণ কোলাহলমূক্ত টাঙ্গুয়ার হাওর। টাঙ্গুয়ার হাওরের অদূরে রয়েছে মেঘালয় পাহাড়। পাহাড়ের পাদদেশে স্বাধীনতা উপত্যকা টেকেরঘাট। মহান মুক্তিযোদ্ধের ৫ নং সেক্টরের সাব সেক্টর টেকেরঘাট। প্রাকৃতিক জীববৈচিত্রের আধার টাঙ্গুয়ার হাওর এখন পর্যটকদের কাছে অতিপ্রিয়।

টাঙ্গুয়ার হাওর আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষিত বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট সুনামগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলায়। হাওর ঘুরা ও ভ্রমণ করার প্রধান বাহন নৌকা। যদিও স্পিডবোটে হাওর ঘুরে দেখা যায়। তবে ভ্রমণের জন্য নৌকাই সবার পছন্দও নিরাপদ।

৬ সেপ্টেম্বর থেকে হটাৎ করে টাঙ্গুয়ার হাওরের পর্যটকবাহী নৌকার ভাড়া প্রায় দ্বিগুন করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় তাহিরপুর উপজেলা প্রশাসনের সাথে কোন ধরনের কথা না বলেই নৌকা ভাড়া দ্বিগুন করেছে তাহিরপুর ট্রলার মালিক সমিতি। ট্রলার মালিক সমিতির ভাড়ার তালিকা সোমবার রাতে সুনামগঞ্জ সদর সার্কেলের অতিরিক্তি পুলিশ সুপারের ফেসবুক আইডি থেকে প্রচার করার পর সেটি ভাইরাল হয়েছে।

সুনামগঞ্জ সদর সার্কেলের ফেসবুক পোস্টে বলা হয়, ‘টাঙ্গুয়ার হাওরের নৌকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। আজ ট্রলার মালিক সমিতির বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়। তারপরেও অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করলে তাহিরপুর থানায় অভিযোগ জানালে পুলিশ ব্যবস্থা নিবে।’ নৌকা ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে ফেসবুকে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন পর্যটকরা।

জানা যায়, দেশের বিভিন্নপ্রান্ত থেকে পর্যটকরা টাঙ্গুয়ার হাওরের পাশাপাশি টেকেরঘাট এলাকার শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ লেক, যাদুকাটা নদী, শিমুল বাগান, বড়গোপ টিলা (বারেক টিলা) ঘুরতে আসেন। টাঙ্গুয়ার হাওরপাড়ে সরাসরি গাড়ি না যাওয়ায় নৌকা নিয়ে সবগুলো স্থান ঘুরেন পর্যটকরা। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, নৌকা চালকরা পর্যটকদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া আদায় করেন। পর্যটকদের দাবির প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে তৎকালীন তাহিরপুর উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা বিজেন ব্যানার্জি নৌযান শ্রমিক ও মালিকদের নিয়ে একটি ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। ওই সময়ে তাহিরপুর বাজারের পাশে খেয়াঘাটের সামনে একটি সাইনবোর্ড ও তাহিরপুর থানার সামনে বৌলাই নদীর দুই তীরে দু’টি সাইনবোর্ড টানানো হয়েছিল। তবে কয়েকদিন পরই খেয়া ঘাটের সাইনবোর্ড ভেঙে মাটিতে ফেলা হয়।

ওই সময়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার টানানো তালিকায় ভাড়া উল্লেখ ছিল, একদিন (নূন্যতম ৮ ঘন্টা হতে ১২ ঘন্টা) ২০ জন পর্যটক নিয়ে ৩ হাজার টাকা, ৩০ জন পর্যটক নিয়ে ৪ হাজার ৫০০ টাকা এবং ৪০ জন পর্যটক নিয়ে ৬ হাজার টাকা আদায় করা যাবে। দুইদিন একরাত ২০ জন পর্যটক নিয়ে ৬ হাজার টাকা, ৩০ জন পর্যটক নিয়ে ৯ হাজার এবং ৪০ জন পর্যটক নিয়ে ১২ হাজার টাকা এবং তিনদিন দুই রাত ২০ জন পর্যটক নিয়ে ৭ হাজার টাকা, ৩০ জন পর্যটক নিয়ে ১০ হাজর টাকা এবং ৪০ জন পর্যটক নিয়ে ১৩ হাজার টাকা করে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু সোমবার রাতে হটাৎ করে তাহিরপুর ট্রলার মালিক সমিতি সভাপতি আবিকুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মো. হুমায়ুন কবির স্বাক্ষরিত টাঙ্গুয়ার হাওর ও টেকেরঘাট যাওয়া পর্যটকবাহী নৌকার ভাড়ার নতুন তালিকা প্রকাশ করেন সুনামগঞ্জ সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ।

নতুন ভাড়ার তালিকায় উল্লেখ করা হয়, তাহিরপুর ঘাট হতে টাঙ্গুয়ার হাওরের ওয়াচটাওয়ার হয়ে টেকেরঘাট হয়ে পুনরায় তাহিরপুর ঘাট ছোট ইঞ্জিন নৌকা (লম্বা ৩০ থেকে ৩৫ হাত) ভাড়া ৪ টাকা। কাঠের বড় ইঞ্জিন নৌকা (লম্বা ৪০ থেকে ৪৫ হাত) ভাড়া ৮ হাজার টাকা। স্টিলের বড় ইঞ্জিন নৌকা (লম্বা ৪৫ থেকে ৫০ হাত) ভাড়া ১২ হাজার টাকা। কিন্তু প্রকাশিত নতুন তালিকায় সময় ও পর্যটকদের সুযোগ সুবিধার বিষয়গুলো উল্লেখ নাই।

নাবিদ হাসান নামের একজন পর্যটক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন, টাঙ্গুয়ার হাওরের নৌকা ভাাড় নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। ট্রলার মালিক সমিতির চাপিয়ে দেওয়া ভাড়া কোনভাবেই কাম্য নয়।’

সুনামগঞ্জ শহরের আরপিন নগরের বাসিন্দা সংস্কৃতিকর্মী মেহেদী হাসান বলেন,‘ ১০/১২ হাজার টাকায় বড় ট্রলার নিয়ে সুনামগঞ্জ থেকে টাঙ্গুয়ার হাওর ও শহীদ সিরাজ লেক কয়েকবার ঘুরে এসেছি। কিন্তু এখন যে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে তা খুব বেশি। এত নৌকা ভাড়া থাকলে মানুষ টাঙ্গুয়ার হাওরে বেড়াতে যাবে না।’ বেশি নৌকা ভাড়ার কারণে পর্যটক কমতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

তাহিরপুর উপজেলা সদর এলাকার এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বললেন,‘ টাঙ্গুয়ার হাওরের নৌকা ভাড়া অবশ্যই অতিরিক্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। শুধু নৌকা ভাড়া করেই হাওর ভ্রমণ করা যায় না। নৌকা ভাড়ার সাথে রান্না করার বাবুর্চিকে হাজার দু’য়েক হাজার করে টাকা দিতে হয়। রান্নার জ¦ালানী গ্যাস সিলিন্ডারের জন্য আরও ৫০০ টাকা গুনতে হয়। নৌকা ভাড়া স্থিতিশীল পর্যায়ে রাখলে পর্যটকদের আগমন বাড়বে।’

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার অক্ষয়নগরের বাসিন্দা আজিজুর রহমান বলেন,‘ টাঙ্গুয়ার হাওরে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু নতুন ভাড়ার তালিকা দেখে যাওয়ার ইচ্ছেটা কমে গেল। ভাবছি একটা নৌকা তৈরির করার পর টাঙ্গুয়ার হাওরে যাব। ’

সোমবার স্টিলের তৈরি বড় ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে সুনামগঞ্জ শহর থেকে টাঙ্গুয়ার হাওর ও টেকেরঘাট ভ্রমণ করেছেন শহরতলীর ইব্রাহিমপুরের অনোয়ারুল হক। ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বললেন,‘ নৌকা ভাড়া তাখিা দেখে মনে মগের মুল্লুক হয়ে গেছে। সোমবার সবচেয়ে বড় নৌকা নিয়ে ১০ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে সুনামগঞ্জ শহর থেকে টাঙ্গুয়ার হাওর ও টেকেরঘাট ঘুরে এসেছি। কিন্তু মঙ্গলবার সকালে দেখি তাহিরপুর থেকেই ১২ হাজার টাকা ভাড়া করা হয়েছে।’

তাহিরপুর ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি আবিকুল ইসলাম বলেন,‘ ভাড়া খুব বেশি হয় নি। আমাদের লোকজন আরও বেশি ভাড়া দাবি করছে। ভাড়ার যে তালিকাটা প্রকাশ হয়েছে সেটা সুনামগঞ্জের সার্কেল এসপি স্যার থানায় বসে করে দিয়েছেন এবং তিনি বলেছেন স্বাক্ষর করতে। এসপি স্যারের কথায় আমরা স্বাক্ষর করেছি। সবাই যদি বলেন, ভাড়া বেশি তাহলে নতুন করে আবার ভাড়ার তালিকা করা হবে। ’ পূর্বের উপজেলা নির্বাহী অফিসারের টানানো ভাড়ার তালিকা ভেঙ্গে ফেলায় তাদের কোন সম্পৃক্ততা নেই, ঝড়-তুফানে ভেঙ্গেছে বলে দাবি করেন তিনি।

সুনাসমগঞ্জ সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জয়নাল আবেদীনের সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েছেন জানিয়েছে, তিনি একটা সভায় আছেন।
সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেন,‘ নৌকা ভাড়ার তালিকা করার বিষয়টি আমাদের নয়। বিষয়টির খোঁজ খবর নেবেন।’

সংবাদটি শেয়ার করুন