বিন্দু তালুকদার, সুনামগঞ্জ :::
যে মানুষটি মহান মুক্তিযুদ্ধে সময় গ্রামের পথে পথে ঘুরে গানের মাধ্যমে গণজাগরণ সৃষ্টি করেছেন, উজ্জীবীত করেছেন মানুষকে ‘আমি বাংলা মায়ের ছেলে…., “শোষক তুমি হও হুশিয়ার, চলো এবার সাবধানে” ‘‘বসন্ত বাতাসে সই গো বসন্ত বাতাসে, বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে….’সহ অসংখ্য কালজয়ী ও গণজাগরণের গানের রচয়িতা বাউল শাহ্ আব্দুল করিমের ১২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ (রবিবার)।
কিংবদন্তিতুল্য এই বাউল স্বশরীরে না থাকলেও তাঁর গান ও সুরধারা কোটি কোটি তরুণসহ সকল স্তরের মানুষের মন ছুঁয়ে যায়। তার ১২ তম মৃতুবার্ষিকী উপলক্ষে বাউলের সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার উজান ধলের গ্রামের বাড়িতে দুপুরে মিলাদ মাহ্ফিল্, রাতে সিমিত পরিসরে বসবে বাউল আসর। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন অনলাইনে পৃথক পৃথক কর্মসূচির আয়োজন করেছে।
শাহ আব্দুল করিম স্বাধীনতা পূর্ব আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি গণসঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে গণজোয়ার সৃষ্টি করেছেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যখন বৃহত্তর সিলেটে গণসংযোগে আসতেন তখন তাঁদের সফর সঙ্গী হতেন শাহ আবদুল করিম। ১৯৫৫ সালে সিলেটের ঐতিহাসিক রেজিষ্ট্রি ময়দানে প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর সিলেট আগমন উপলক্ষ্যে জনসভায় শাহ আবদুল করিম গণসঙ্গীত গেয়েছিলেন। ১৯৫৭ সালে ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে শাহ আবদুল করিমের গান শুনে মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তাঁর পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন,‘তুমি ভবিষ্যতে গণমানুষের মহান শিল্পী হবে’। সেদিন গণসঙ্গীতে মুগ্ধ হয়ে ভাসানী ১৮৫ টাকা পুরষ্কার প্রদান করেন। ১৯৬৭ সালে সুনামগঞ্জে এক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান আবদুল করিম সংগীত শুনে তাঁকে ১১০০ টাকা দিয়ে বলেছিলেন ‘আমি যতই করিম ভাইকে দেখছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। এ দেশের উন্নয়নে আপনারমতো গুণী শিল্পীর প্রয়োজন অনেক’। পরে ১৯৬৯ সালে আবারো সুনামগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর সভামঞ্চে শাহ আবদুল করিম গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন। গণসঙ্গীত শুনে আবেগে আপ্লুত হয়ে বঙ্গবন্ধু মাইকে দাড়িয়ে বলেছিলেন ‘শেখ মুজিব বেঁচে থাকলে করিম ভাইও বাঁচবে” এসময় তিনি শাহ আবদুল করিমকে পাঁচশত টাকা উপহার দেন।
বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম তাঁর উজান ধল গ্রামে নিজ বাড়িতে ‘শাহ আবদুল করিম সংগীতালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর রচিত ভাটিয়ালী, মুর্শিদী, দেহতত্ত্ব, গণসঙ্গীত ইত্যাদি অসংখ্য গান দেশের সীমানা পেরিয়ে বহির্বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। হাওর অধ্যুষিত সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার ধল গ্রামে জন্ম নেয়া সৃজনশীল সৃষ্টি কর্মের উজ্জল নক্ষত্র, অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম ২০০৯ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর সিলেট শহরে একটি ক্লিনিকে মৃত্যুবরণ করেন।
অসংখ্য গণজাগরণের গানের রচয়িতা শাহ্ আব্দুল করিম ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দিরাই উপজেলার তাড়ল ইউননিয়নের উজানধল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সমাজ পরিবর্তনের স্বাপ্নিক বাউল ছিলেন শাহ্ আব্দুল করিম। আমৃত্যু তিনি উজানধল গ্রামেই ছিলেন। অত্যন্ত সহজ-সরল জীবন যাপন করতেন তিনি। গানে-গানে অর্ধ শতাব্দিরও বেশী লড়াই করেছেন ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে। এজন্য মৌলবাদীদের দ্বারা নানা লাঞ্চনারও শিকার হয়েছিলেন তিনি। ২০০১ সালে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা একুশে পদক পান ক্ষণজন্মা এ বাউল। প্রতি বছরের মতো এবারও গণ-মানুষের প্রিয় এই বাউলের মৃত্যুবার্ষিকীকে ঘিরে তাঁর ভক্ত বাউলরা সমবেত হবেন তাঁর বাড়িতে।
সুনামগঞ্জের বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী দেবদাস চৌধুরী রঞ্জন বলেন,‘ দীর্ঘদিন ধরে আমরা বাউল স¤্রাট আব্দুল করিমের নামে একটি একাডেমি স্থাপনের জন্য জোর দাবি জানিয়েছে আসছি। কিন্তু আমাদের দাবি বাস্তবায়নে আলোর মুখ দেখছে না। ’
শাহ আব্দুল করিম পরিষদের সভাপতি ও তার ছেলে বাউল শাহ নূর জালাল বলেন,‘ দুঃখজনক হলেও সত্য আজ পর্যন্ত বাবার নামে দিরাইয়ে একটি সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি। বাবার নামে একটি একাডেমী গড়ার জন্য অনেকবার আলোচনা হয়েছে। চিঠি চালাচালি হয়েছে কিন্তু এখনও জায়গা নির্ধারণ করা হয়নি। বাবার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আজ আমাদের বাড়িতে দুপুরে মিলাদ মাহ্ফিল হবে। বিভিন্ন এলাকার বাউল ভক্ত আসবেন। রাতে বাউল আসর বসবে। বড় কোন কর্মসূচির হাতে নেওয়া হয়নি। ’
সুনামগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. শামছুল আবেদীন বললেন,‘ বাউল স¤্রাট আব্দুল করিম ছিলেন বাঙালি জাতির একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীক। তিনি শুধু প্রেমের গানই লেখেননি তিনি গরিব-দুঃখি মানুষের সাথে ছিলেন। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও মৃৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হবে। তাঁর নামে একটি একাডেমি স্থাপনের কাজ চলছে। জমি নির্ধারণ প্রক্রিয়াধীন আছে। আমরা আশা করছি শিঘ্রই শাহ আব্দুল করিম একাডেমির কাজ শুরু করতে পারব।