• ২৪শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১১ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ১৫ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

দৃশ্যমান করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা এবং অশ্রুত আখ্যান : অপূর্ব শর্মা

Daily Jugabheri
প্রকাশিত এপ্রিল ৩, ২০২৩
দৃশ্যমান করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা এবং অশ্রুত আখ্যান : অপূর্ব শর্মা

সাক্ষাৎকার

দেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মাঠ পর্যায়ে গবেষণায় যে ক’জন গবেষক নিবিষ্ট রয়েছেন তারমধ্যে অপূর্ব শর্মা অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধের ছাইচাপা পড়ে থাকা ইতিহাস তুলে আনতে তিনি পালন করে চলেছেন এক অনন্য এবং অতুলনীয় ভূমিকা। একাত্তরের আত্মত্যাগের অশ্রুত আখ্যান যেমন তিনি তুলে আনছেন পরম নিষ্ঠার সঙ্গে তেমনই বীরত্বের আখ্যানও বর্ণনা করছেন দ্বিধাহীনভাবে। পাশাপাশি সংবেদনশীলভাবে উপস্থাপন করছেন বীরাঙ্গনাদের অগ্নিভাষ্য। যুদ্ধাপরাধীদের স্বরূপ উন্মোচনেও তিনি আপোষহীন। এক কথায় মুক্তিযুদ্ধের অনালোকিত-অনালোচিত দিক জাতির সামনে তুলে ধরতে বিরামহীনভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন অপূর্ব শর্মা। সে কারণেই তাঁর নামের পাশে সংযোজিত হয়েছে ‘প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা’র বিশেষণ। জাতীয়ভাবে একাধিক পুরস্কার প্রাপ্ত এই মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার শহিদ স্মৃতি উদ্যান, সিলেট-এর মাধ্যমে আবারো আলোচনায় এসেছেন। সিলেট ক্যাডেট কলেজ সংলগ্ন সালুটিকর বধ্যভূমিতে মুক্তিযুদ্ধে শহিদ সূর্য সন্তানদের নাম অনুসন্ধান করে বের করা এবং এই উদ্যান বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য হিশেবে তাঁর ভূমিকা প্রশংসিত হচ্ছে সর্বমহলে। স্মৃতি উদ্যানের পটভূমিতে তাঁর অবদানকে মূল্যায়ন করা হয়েছে এভাবে-‘এনিয়ে পূর্বে কোনো ধরণের গবেষণা না হওয়ায় তাঁর জন্য অনুসন্ধান প্রক্রিয়াটি ছিলো দুরূহ এবং কঠিন। শহিদদের নাম অনুসন্ধানে এই চেষ্টা ছিল এক নতুন বিজয়ের সন্ধানে আত্মত্যাগ।’

পরম নিষ্ঠার সাথে দীর্ঘ এই অভিযাত্রা সম্পন্ন করেছেন অপূর্ব শর্মা। একাত্তরে সালুটিকর বধ্যভূমি ও সংলগ্ন এলাকায় নির্মম নির্যাতনের পর যেসব মুক্তিকামীকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল হানাদার বাহিনীর সদস্যরা-তাদের আত্মত্যাগের আখ্যান এতকাল ছিলো লোকচক্ষুর অন্তরালে। ছাইচাপা পড়ে থাকা শহিদদের নাম তিনি তুলে এনেছেন পরম নিষ্ঠা, মমতা এবং একাগ্রতায়। ৫২ বছরের পুরনো ঘটনার বিস্তৃত বিবরণ বের করতে তাঁকে যেমন দীর্ঘ অনুসন্ধান চালাতে হয়েছে তেমনি ঘুরে বেড়াতে হয়েছে শহরের অলিগলি থেকে শুরু করে গ্রামের পর গ্রাম। ধূলিমাখা রাস্তা যেমন পারি দিতে হয়েছে তেমনি অতিক্রম করতে হয়েছে কাদামাখা পথ। রোদে যেমন পুড়তে হয়েছে তেমনি ভিজতে হয়েছে বৃষ্টিতে। যেতে হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। কথা বলতে হয়েছে অগণন মানুষের সাথে। অপূর্ব শর্মার অক্লান্ত পরিশ্রম এবং দীর্ঘ অনুসন্ধানের ফলে এই বধ্যভূমির ইতিহাস এবং শহিদদের একটি অসম্পূর্ণ তালিকা প্রণয়ন করা সম্ভব হয়েছে। অনুসন্ধান এবং স্মৃতি উদ্যান নির্মাণের আদ্যোপান্ত জানতে ফারজানা নাজ শম্পা অপূর্ব শর্মার মুখোমুখি হয়েছিলেন। বিশেষ এই আলাপচারিতার অংশবিশেষ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

প্রশ্ন: প্রথমেই সিলেট ক্যাডেট কলেজ সংলগ্ন বধ্যভূমি সম্পর্কে জানতে চাই?

অপূর্ব শর্মা: মুক্তিযুদ্ধচলাকালে সিলেট শহরের নিকটবর্তী তৎকালীন সিলেট রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলকে (বর্তমান সিলেট ক্যাডেট কলেজ) আবর্তিত করে একটি মিনি ক্যান্টনমেন্ট প্রতিষ্ঠা করেছিল হানাদার বাহিনীর সদস্যরা। পাশেই বিমানবন্দর থাকায় সহজেই এই স্থানটিতে তারা মজবুত সুরক্ষা বলয় তৈরি করে। এখানে এহেন অপকর্ম নেই যা তারা করেনি। ধরে আনা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের উপর চালানো হতো পৈশাচিক নির্যাতন, তাদের শরীর থেকে নেয়া হতো রক্ত, নারীদের উপর চালানো হতো পাশবিকতা। নির্যাতন শেষে চোখে কালো কাপড়, হাত পেছনে বেঁধে বধ্যভূমিতে এনে গুলিতে ঝাঁঝরা করা হতো মুক্তিকামীদের বুক। এরপর তাদেরকে গর্ত খুরে পুতে ফেলা হতো লাশ।

সুরমা উপত্যকার অন্যতম বৃহৎ এ বধ্যভূমিতে সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে এনে নারী পুরুষ নির্বিশেষে হত্যা করা হয় অগণিত মানুষকে। এই স্থানটিতে ঘুমিয়ে আছেন মুক্তিযোদ্ধা, পেশাজীবী, সাধারণ জনগণ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাম জানা না জানা অগণন নিরীহ মুক্তিকামী মানুষ।

প্রশ্ন: এই বধ্যভূমিতে আনুমানিক কতো মানুষ হত্যা করা হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

অপূর্ব শর্মা: মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী এই বধ্যভূমিতে শহিদদের সংখ্যা নিয়ে নানা তথ্য পাওয়া যায়। দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে আমার অনুমান, এখানে দুই হাজারের অধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।

প্রশ্ন: স্বাধীনতা পরবর্তী এই বধ্যভূমিতে কি কোনও অনুসন্ধান চালানো হয়েছিল?

অপূর্ব শর্মা: হ্যাঁ, হয়েছিল। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে এই বধ্যভূমিতে সরকারের পক্ষ থেকে অনুসন্ধান চালানো হয়। এই বধ্যভূমি থেকে ৪ হাজার হাড়, ২৪ টি মাথার খুলি ও ৪টি নরকঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। তবে দু’একজন ছাড়া কারোরই পরিচয় পাওয়া যায়নি সে সময়।

প্রশ্ন: শুধু কি মুক্তিকামী পুরুষদেরকেই এই বধ্যভূমি ও সংলগ্ন এলাকায় হত্যা করা হয়েছিল?

অপূর্ব শর্মা: না। এখানে অনেক নারীকেও হত্যা করা হয়। এদের প্রায় সবারই পরিচয় অজানা রয়ে গেছে।

প্রশ্ন: কেন এমনটি হলো, নারীদের পরিচয় অজ্ঞাত থাকার বিশেষ কোনও কারণ আছে কি?

অপূর্ব শর্মা: নির্যাতিত এবং হত্যাকাণ্ডের শিকার নারীদের বড়ো একটি অংশ মণিপুরি সম্প্রদায়ের ছিলেন, বাকিরা হিন্দু এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের। এদের অনেকের পরিবারই হারিয়ে গেছে যুদ্ধের দামামায়। আবার কারো কারো পরিবার চলে গেছে ভারতে। অবশিষ্ট যারা দেশে আছেন তারাও লোকলজ্জার ভয়ে লুকিয়ে রেখেছেন বীভৎসতার পর হত্যার কথা। আবার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ধরে এনে নির্যাতনের পর হত্যার কারণে তাদের পরিচয় থেকে গেছে অজ্ঞাত।

প্রশ্ন: শহিদ নারীদের পরিচয় বের করতে কি অনুসন্ধান চালাবেন আপনি?

অপূর্ব শর্মা: অবশ্যই। শুধু নারীরা নন, এই বধ্যভূমিতে শহিদদের আত্মপরিচয় বের করতে আমার অনুসন্ধান প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। আশাকরি আগামী বিজয় দিবসের পূর্বে আরও কয়েকজন শহিদদের নাম আমরা শহিদ স্মৃতি উদ্যানে যুক্ত করতে পারবো।

প্রশ্ন: এই বধ্যভূমিতে এতো মুক্তিকামীকে কিভাবে হত্যা করা হয়?

অপূর্ব শর্মা: এই বধ্যভূমি সংলগ্ন সিলেট রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে একটি বন্দিশালা গড়ে তুলেছিল হানাদার বাহিনীর সদস্যরা। এটি ছিলো সিলেটের অন্যতম বৃহৎ বন্দিশালা। মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিকামীদের কাছ থেকে তথ্য আদায়ের জন্য প্রথমে তাদেরকে বন্দিশালায় আটক করে তাদের উপর অবর্ণনীয় পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হতো। এরপর তাদেরকে সংলগ্ন বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে গুলিতে ঝাঁঝরা করা হতো বুক।

প্রশ্ন: শুধু কি গুলি করেই এখানে মুক্তিকামীদের হত্যা করা হয়েছে?

অপূর্ব শর্মা: না। এখানে প্রাণ শহিদদের একটি অংশ মারা গেছেন রক্তশূন্যতায়।

প্রশ্ন: রক্তশূন্যতার বিষয়টি যদি একটু ক্লিয়ার করেন?

অপূর্ব শর্মা: সিলেট রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের বন্দিশালায় আটক মুক্তিকামীদের শরীর থেকে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে রক্ত নিতো হানাদার বাহিনীর সদস্যরা। এই রক্ত তারা সীমান্তে বা বিভিন্ন যুদ্ধ ক্ষেত্রে আহত সৈনিকদের অপারেশনের সময় ব্যবহার করতো।

একেক জন বন্দির শরীর থেকে যখন খুশি তখন রক্ত নিয়েছে। এর আগে মিলিয়ে নিতো গ্রুপ। অধিক রক্ত নেয়ার কারণে যারা জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে চলে যেতো তাদের বধ্যভূমিতে ফেলে আসতো।

প্রশ্ন: মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে এমন কাউকে কি পেয়েছেন যার শরীর থেকে রক্ত নিয়েছে পাকিরা এবং ভাগ্যক্রমে তিনি প্রাণে বেঁচে গেছেন?

অপূর্ব শর্মা: হ্যাঁ, এরকম কয়েকজনকে পেয়েছি। যাদেরকে আটকের পর বন্দিশালায় রাখা হয়েছিল। এদের শরীর থেকে একাধিকবার রক্ত নিয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে তাদেরকে কারাগারে পাঠানো হয়। তাদের খোঁজে বের করে তাদের কাছ থেকেও বেশ কিছু তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেছি।

প্রশ্ন: যে বন্দিশালা সম্পর্কে বললেন, সেটি নিয়ে কি কোনো গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশের ইচ্ছে আছে?
অপূর্ব শর্মা: সিলেটের বৃহৎ এই বন্দিশালা নিয়ে আমার গবেষণা প্রায় শেষ পর্যায়ে। শিগগির এ নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হবে।

প্রশ্ন: এবার এখানে শহিদ স্মৃতি উদ্যান নির্মাণ প্রসঙ্গে জানতে চাই?

অপূর্ব শর্মা: সিলেট ক্যাডেট কলেজ সংলগ্ন সালুটিকর বধ্যভূমিটি দীর্ঘদিন অবহেলিত ছিল। শহিদ পরিবারের অফুরন্ত ইচ্ছায় স্থানীয় জনগণের প্রত্যাশায় সেনাবাহিনী প্রধানের নিকট আবেদনের প্রেক্ষিতে সিলেট এরিয়া কমান্ডারের বিশেষ সহযোগিতায় এখানে একটি স্মৃতি উদ্যান তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব) আবদুস সালাম বীর প্রতীক এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জিয়া উদ্দিন আহমদ এখানে শহিদ স্মৃতি উদ্যান নির্মাণের উদ্যোগ নেন এবং এর সঙ্গে আমাকে যুক্ত করেন। বধ্যভূমিতে শহিদদের নাম অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয় আমাকে।

প্রশ্ন: এই কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়নে কি কোনো কমিটি গঠন করা হয়েছিল?

অপূর্ব শর্মা: হ্যাঁ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার শহিদ স্মৃতি উদ্যান নির্মাণে ৩ সদস্যের একটি বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়। ৩ সদস্য বিশিষ্ট বাস্তবায়ন কমিটির সদস্যরা হলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল আবদুস সালাম বীর প্রতীক এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জিয়া উদ্দিন আহমদ এবং আমি (অপূর্ব শর্মা)। বাস্তবায়ন কমিটিকে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন, সেনাবাহিনী সিলেটের এরিয়া কমান্ডার এবং অধ্যক্ষ সিলেট ক্যাডেট কলেজ।

প্রশ্ন: বধ্যভূমিতে যাদেরকে ধরে এনে হত্যা করা হয়েছিল, কিভাবে খোজে পেলেন তাদের?

অপূর্ব শর্মা: এই প্রক্রিয়াটি ছিলো দুরূহ এবং কঠিন। সেইসাথে সময় সাপেক্ষ। যদিও ২০১০ সাল থেকে এই বধ্যভূমিতে শহিদদের নাম অনুসন্ধানে কাজ করছিলাম আমি। কিন্তু বিগত ২ বছর একটানা অনুসন্ধান চালিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী পত্র-পত্রিকা, গবেষণা গ্রন্থ এবং মাঠ পর্যায়ে দীর্ঘ অনুসন্ধান চালিয়ে, প্রতিটি শহিদ পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে এপর্যন্ত ৬৬ জনের নাম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। অনুসন্ধান প্রক্রিয়াটি চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে আরও দু’জন শহিদের নাম পাওয়া গেছে।

আমাদের বিশ্বাস এভাবে যদি দেশের প্রতিটি বধ্যভূমিতে আত্মাহুতি দেয়া শহিদদের নাম অনুসন্ধান করে বের করার উদ্যোগ নেয়া হয় এবং এরকম উদ্যান নির্মাণ করা হয় তাহলে সময়ের স্রোতে ছাইচাপা পড়ে থাকা শহিদদের নাম যেমন উঠে আসবে, একইভাবে জানা যাবে শহিদদের আত্মত্যাগের আখ্যান।

প্রশ্ন: এই স্মৃতি উদ্যানের বিশেষত্ব কি?

অপূর্ব শর্মা: আমার জানামতে দেশের যেসব বধ্যভূমিতে শহিদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে সেই বধ্যভূমিগুলোতে কারা প্রাণ হারিয়েছেন সে সম্পর্কে কোনও তথ্য উপস্থাপিত হয়নি। স্বাধীনতার শহিদ স্মৃতি উদ্যান এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এখানকার মূল তিনটি স্তম্ভের দুটিতে বাংলা এবং ইংরেজিতে লেখা রয়েছে ৬৬ জন শহিদের নাম। মাঝের স্তম্ভে তুলে ধরা হয়েছে ইতিহাস। এছাড়াও দুইপাশে ৩৩ জন করে ৬৬ জনের নামে আলাদা স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। সঙ্গে আছে ঠিকানা। পাশাপাশি নির্মাণ উদ্যোগের আখ্যান এবং পটভূমিও তুলে ধরা হয়েছে। সেইসঙ্গে আছে স্বতন্ত্র কয়েকজন শহিদদের আত্মবলিদানের আখ্যান।

প্রশ্ন: এভাবে স্মৃতি উদ্যান নির্মাণের বিশেষ কোনও কারণ আছে কি?

অপূর্ব শর্মা: বিশেষ একটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এমনটি করা হয়েছে। সেটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের আত্মত্যাগকে দৃশ্যমান করা। প্রত্যেক শহিদের নাম ঠিকানা এবং বাবার নাম যখন জানতে পারবেন পরিদর্শনে আসা মানুষ তখন তিনি কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে পারবেন, উপলব্ধি করতে পারবেন কি ধরণের ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার পর মুক্তিকামীদের হত্যা করা হয়েছে দেশের বধ্যভূমিগুলোতে।

আরেকটি বিষয়, সেটি হচ্ছে স্বীকৃতি। যেসব শহিদদের কেউ কখনও খোঁজ নেয়নি, এরমাধ্যমে তাদের আত্মত্যাগের কথা জানতে পারবে মানুষ। পাশাপাশি এই বধ্যভূমিতে ধরে এনে যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে, তাদের পরিবারের সদস্যদের দীর্ঘশ্বাস ফেলার কিংবা কান্নার, জিয়ারত কিংবা প্রার্থনার কোনও স্থান ছিলো না এতদিন। শহিদ স্মৃতি উদ্যানের মধ্যদিয়ে সেটা হয়েছে। শহিদদের সন্তানেরা, স্বজনেরা অবশেষে খোঁজে পেয়েছে স্বাধীনতার বেদিমূলে আত্মাহুতি দেওয়া সূর্য সন্তানদের শেষ ঠিকানা। তাহলে যাদের প্রাণের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি মুক্ত স্বাধীন মাতৃভূমি. তাদের কথা জানতে পারবে মানুষ।

আমি মনে করি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাস্তবায়ন করতে হলে যুদ্ধের অশ্রুত আখ্যানের পাশাপাশি গৌরবগাঁথাকে আরও বেশি বেশি দৃশ্যমান করতে হবে। ইতিহাসকে তুলে ধরতে হবে নতুন প্রজন্মের কাছে। তাহলে তারা কখনও বিভ্রান্ত হবেনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমৃদ্ধ দেশ গঠনে এর কোনো বিকল্প নেই।

প্রশ্ন: এই উদ্যান প্রতিষ্ঠার পর সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাই?

অপূর্ব শর্মা: এই স্থানটিকে নান্দনিক রূপ প্রদানের মাধ্যমে শহিদ ও তাঁদের পরিবারের প্রতি জাতির শ্রদ্ধা ও স্বীকৃতিস্বরূপ এই স্মৃতি উদ্যান তৈরি করা হয়েছে। স্মৃতি উদ্যানের নকশা করেন স্থপতি শাহরিয়ার আহমদ। যেহেতু সিলেট অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি ছিলো এখানে একটি স্মৃতি উদ্যান নির্মাণের সে কারণে সে কারণে সবাই খুশি। এর প্রতিফলন দেখা গেছে বিগত ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে। আমরা বাস্তবায়ন কমিটির পক্ষ থেকে আহ্বান জানিয়েছিলাম স্বাধীনতা দিবসে স্বাধীনতার শহিদ স্মৃতি উদ্যানে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের। দল মত নির্বিশেষে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ সেদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেছেন স্মৃতি উদ্যানে। এসেছিলে শহিদ পরিবারের সদস্যরাও।

প্রশ্ন: এই উদ্যান নিয়ে শহিদদের সন্তান এবং স্বজনদের অনুভূতি কি?

অপূর্ব শর্মা: গত ৪ মার্চ এই উদ্যান উদ্বোধন করা হয়। ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে এক বিঘা জায়গার ওপর নির্মিত এই উদ্যানের উদ্বোধন করেন শহিদ সৈয়দ সিরাজুল আব্দালের স্ত্রী সৈয়দা সাকিনা আব্দাল। এই অনুষ্ঠানে অর্ধশতাধিক শহিদ পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। সেদিন প্রথমবারের মতো তারা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তাদের স্বজনদের। এদের অনেকেই সেদিন কান্নায় ভেঙে পড়েন। সকলেই আপ্লুত। তাদের অনুভূতি এমন তারা যেন তাদের স্বজনদের খুঁজে পেয়েছেন ৫২ বছর পর।

প্রশ্ন: আপনার অনুভূতি জানতে চাই?

অপূর্ব শর্মা: আমি আপ্লুত। শুধু আমি নই আমরা যারা স্বাধীনতার শহিদ স্মৃতি উদ্যান বাস্তবায়নের সাথে নানাভাবে সম্পৃক্ত ছিলাম সবাই খুশি। কারণ যাদের প্রাণের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি মুক্ত স্বাধীন মাতৃভূমি. তাদের কথা জানতে পারবে মানুষ। এর মধ্য দিয়ে কিছুটা হলেও আমরা ঋণ শোধের চেষ্টা করেছি। যদিও শহিদদের ঋণ অপরিশোধ্য।

প্রশ্ন: দীর্ঘ সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ

অপূর্ব শর্মা: আপনাকেও ধন্যবাদ।

সংবাদটি শেয়ার করুন