যুগভেরী ডেস্ক ::: আজ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আজকের দিনটি জনগণের ক্ষমতা প্রয়োগের দিন। ভোটের মাধ্যমে আজ তারা আগামী পাঁচ বছরের জন্য দেশ পরিচালনায় জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করবেন। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সব প্রস্তুতি ইতোমধ্যে সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীন ভোটগ্রহণ চলবে ২৯৯ আসনে। নওগাঁ-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আমিনুল ইসলাম মারা যাওয়ায় ওই আসনের নির্বাচন স্থগিত করেছে ইসি। সে সঙ্গে নিরপেক্ষা, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য আজ কঠোর অবস্থানে থাকার ঘোষণাও দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। শনিবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে যেকোনো মূল্যে গ্রহণযোগ্য এক নির্বাচন আয়োজনে কমিশনের আন্তরিক প্রচেষ্টার বিষয় উল্লেখ করে সব ভোটারকে ভোট প্রদানের আহ্বান জানান প্রধান নির্বাচন কমিশনার। এদিকে নির্বাচন উপলক্ষে গতকাল (শনিবার) ও আজ (রোববার) সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। গেল বছর ১৫ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণ প্রদানের মাধ্যমে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। বিগত বছরজুড়ে এ জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে নির্বাচন কমিশন, যার অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে আজ। অন্যদিকে নির্বাচনে ভোটাররা যেন উপস্থিত না হন সে জন্য ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ উঠেছে বিএনপি-জামায়াত জোটের বিরুদ্ধে। নির্বাচনের আগ মুহূর্তে বেশকিছু ভোট কেন্দ্রে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় এমনটাই মনে করছেন নির্বাচনে অংশ নেওয়া দলগুলো। কিন্তু বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করেই উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন প্রার্থীরা। সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে বাধা প্রদানকারীদের ওপর সম্প্রতি ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ভোটাররা যাতে ভোটকেন্দ্রে অবাধে যাতায়াত করতে পারে সে জন্য মাঠ পর্যায়ে পুলিশ, র্যাব, আনসার-ভিডিপি, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ডসহ সব মিলিয়ে প্রায় ৮ লাখ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। নির্বাচনের দিন ভোট গ্রহণের কাজে ৮ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োজিত থাকছেন। এ ছাড়া ১ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ৩ হাজার ম্যাজিস্ট্রেট ও বিচারক মাঠে থাকবেন। তারা যেকোনো অপরাধে তাৎক্ষণিক শাস্তি দিতে পারবেন। এ ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ বজায় রাখার জন্য সেনা বাহিনীও থাকছে মাঠে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে ভোটকেন্দ্র, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং ভবনের নিরাপত্তা জোরদার ও নজরদারি বৃদ্ধির নির্দেশ দিয়েছে ইসি। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য স্থাপনায় মোট ৪২ হাজার ২৪টি ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি, সম্পাদক বা অনুরূপ কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষের সঙ্গে সভা করে বা যোগাযোগের মাধ্যমে অথবা দায়িত্ব দিয়ে ভোট কেন্দ্রের নিরাপত্তা ও নজরদারি বৃদ্ধি করার নির্দেশনা আগেই প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু ইসির এই নির্দেশনার পরও দেশজুড়ে প্রায় ৭টি স্থানে পোলিং সেন্টারে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, ভোটারদের ভয় দেখিয়ে ভোট কেন্দ্রে আসা থেকে বিরত রাখতেই এই কৌশল গ্রহণ করেছে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা বিএনপি-জামায়াত জোট। যদিও বিএনপির দাবি করা সরকার পতন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবির প্রতি কোনো সমর্থনই জানায়নি আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলো। এবার ভোটে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে ৬৬ জন দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে দুইজন বিভাগীয় কমিশনার এবং ৬৪ জন জেলা প্রশাসক। কমিশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৯টি সংসদীয় আসনে ১ হাজার ৯৭০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ইসিতে নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে এ নির্বাচনে ২৮টি রাজনৈতিক দলের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১ হাজার ৫৩৪ জন প্রার্থী। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে আছেন ৪৩৬ জন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী ২৬৬, জাতীয় পার্টির ২৬৫, তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী ১৩৫, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ৬৬ জন, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ১২২ জন, জাতীয় পার্টির (জেপি) ১৩ জন, ওয়ার্কার্স পার্টির ২৬ জন, বিকল্পধারা বাংলাদেশের ১০ জন প্রার্থী রয়েছেন। নির্বাচনে নারী প্রার্থী হিসেবে রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৯০ জন। আর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসহ অন্যান্য মিলে ৭৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন। এ ছাড়া এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৃতীয় লিঙ্গের একজন প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন। ২৯৯ সংসদীয় আসনে মোট ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ৪২ হাজার ২৪টি। এসব কেন্দ্রে বুথ রয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৯১২টি। এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৮৯ হাজার ২৮৯ জন, যার মধ্যে পুরুষ ভোটারের সংখ্যা ৬ কোটি ৭৬ লাখ ৯ হাজার ৭৪১ ও নারী ভোটারের সংখ্যা ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৮ হাজার ৬৯৯ জন। এ ছাড়া সারা দেশে এবার তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার আছেন ৮৪৯ জন। এবারই প্রথমবারের মতো ভোটের দিন সকালে কেন্দ্রে ব্যালট পেপার প্রেরণ করা হয়েছে। তবে দুর্গম অঞ্চলের ২ হাজার ৯৬৪টি কেন্দ্রে ব্যালট পেপার শনিবার পৌঁছে গেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে অনুমতি পেয়েছেন স্থানীয় ২০ হাজার ৭৭৩ জন পর্যবেক্ষক। এ ছাড়া দুই শতাধিক বিদেশি পর্যবেক্ষককে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে জানান নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ। বিদেশি ১২৮ জন পর্যবেক্ষক আর ৭৩ জন গণমাধ্যমকর্মীকে এবার পর্যবেক্ষণের অনুমোদন প্রদান করা হয়েছে। নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্য গত ৩ জানুয়ারি থেকে সেনাবাহিনী ৬২টি জেলায় নিয়োজিত রয়েছে। উপকূলীয় দুটি জেলাসহ (ভোলা ও বরগুনা) সর্বমোট ১৯টি উপজেলায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর দায়িত্ব পালন করছে। সমতলে সীমান্তবর্তী ৪৫টি উপজেলায় বিজিবি এককভাবে দায়িত্ব পালন করছে এবং সীমান্তবর্তী ৪৭টি উপজেলায় সেনাবাহিনী বিজিবির সঙ্গে এবং উপকূলীয় ৪টি উপজেলায় কোস্ট গার্ডের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে যৌথভাবে দায়িত্ব পালন করছে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী হেলিকপ্টারের সহায়তায় দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের ভোটকেন্দ্রগুলোতে প্রয়োজনীয় হেলিকপ্টার সহায়তা প্রদান করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। নির্বাচনে ১ লাখ ৮২ হাজার ৯১ জন পুলিশ ও র্যাব সদস্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় মোতায়েন করা হয়েছে। গত ২৯ ডিসেম্বর থেকে সারা দেশে ৪৮৭টি বেজ ক্যাম্পে ১ হাজার ১৫৫ প্লাটুন বিজিবি নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। সারা দেশে নাশকতা এড়াতে বিস্ফোরক দ্রব্যের ওপর বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত বিজিবি ডগ স্কোয়াড দেশের বিভিন্ন স্থানে কাজ করছে। একই সঙ্গে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে বিজিবির বিশেষায়িত ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন টিম (র্যাট)। সে সঙ্গে বিজিবির কুইক রেসপন্স ফোর্সও প্রস্তুত রয়েছে, যারা বিজিবির অত্যাধুনিক হেলিকপ্টারের মাধ্যমে দেশের যেকোনো প্রান্তে যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সক্ষমতা রাখে। নির্বাচনে নিরাপত্তা রক্ষায় ৫ লাখ ৫ হাজার ৭৮৮ জন সাধারণ আনসার ও ভিডিপি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। তারা গত ২৯ ডিসেম্বর থেকে কাজ শুরু করেছে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত মাঠে থাকবে। নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, গুরুত্বপূর্ণ ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২ লাখ ১৫ হাজার সদস্য মোতায়েন রয়েছে এবং সাধারণ ভোটকেন্দ্রে রয়েছে ৪ লাখ ৭২ হাজার সদস্য। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ১৫ থেকে ১৭ জনের নিরাপত্তা সদস্যের একটি দল মোতায়েন করা থাকছে। নির্বাচন কমিশন জানায়, মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরে অস্ত্রধারী দু’জন পুলিশ, অস্ত্রধারী একজন আনসার, অস্ত্র বা লাঠিধারী একজন আনসার, ১০ জন আনসার, লাঠি হাতে একজন বা দু’জন গ্রামপুলিশ সদস্যসহ ১৫ থেকে ১৬ জনের একটি করে দল সব সাধারণ ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা দেবে। তবে প্রতি গুরুত্বপূর্ণ ভোটকেন্দ্রের ক্ষেত্রে অস্ত্রসহ ৩ জন পুলিশসহ ১৬ থেকে ১৭ জনের দল থাকবে। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, যেকোনো স্থানে অনিয়ম ও ভোট চুরি বা ভোট দানে বাধা দেওয়ার তথ্য পেলে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নেব। কেউ অতিরিক্ত পেশিশক্তি প্রদর্শন করলে ওই কেন্দ্রে ভোট বাতিলও করা হতে পারে। মোটকথা নির্বাচনী আচরণ পরিপন্থি যেকোনো কাজ করলেই আমরা অ্যাকশনে যাব। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে এখন পর্যন্ত বেশ কঠোর অবস্থানেই দেখা যায় ইসিকে।
সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি : নূরুর রশীদ চৌধুরী, সম্পাদক : ফাহমীদা রশীদ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক : ফাহমীনা নাহাস
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : অপূর্ব শর্মা