ছোট বড় অসংখ্য টিলা নিয়ে সিলেট। এসব টিলার পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে প্রায় ১০ হাজার পরিবার। মৃত্যু ঝুঁকি নিয়েই টিলার নিচে ঘর নির্মাণ করে বসবাস করছেন তারা। টানা বৃষ্টির কারণে সিলেটের পাহাড় টিলা ধসের শংকা দেখা দিয়েছে। ফলে প্রাণহানির শঙ্কাও বেড়েছে।
সোমবার (১০ জুন) সিলেট নগরের মেজরটিলা এলাকায় একটি টিলা ধসে মাটি চাপা পড়ে একই পরিবারের তিন সদস্য নিহত হন। এতে আহত হন আরও তিনজন।
গত কয়েকদিন থেকেই সিলেটে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। এরমধ্যে সোমবার সকাল ৬ টার দিকে মেজরটিলায় চামেলিবাগ এলাকার দুই নম্বর সড়কের একটি টিলা ধসে ৮৯ নম্বর বাসার উপর পড়ে। এতে এই বাসায় ভাড়া থাকা ছয় সদস্য মাটির নিচে চাপা পড়েন। তিনজনকে তাৎক্ষণিক জীবিত উদ্ধার করা হয়। তাদের আহত অবস্থায় সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আর প্রায় ছয় ঘন্টা অভিযান চালিয়ে সেনাবাহিনীর সহযোগীতায় বাকী তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
নিহতরা হলেন- আগা করিম উদ্দিন (৩১), তার স্ত্রী শাম্মী আক্তার রুজি (২৫) ও তাদের শিশু সন্তান নাফজি তানিম ।
প্রতিবছরই সিলেটে এমন টিলা ধসে হতাহতের ঘটনা ঘটে। তবু টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস থামছে না। এ ব্যাপারে প্রশাসনের ভ’মিকা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
সিলেটে কি পরিমাণ লোক টিলার পাদদেশে বসাবাস করেন সরকারিভাবে এর কোন তালিকা নেই, তবে বেসরকারি হিসেবে প্রায় ১০ হাজার পরিবার টিলার পাদদেশে বসবাস করছে। মূলত কম ভাড়ায় কিংবা বিনা ভাড়ায় থাকতে পারার কারণেই দরিদ্র শ্রেণির লোকেরাই টিলার পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করেন। আবার কিছু গোষ্ঠি টিলা কাটা বা দখলে রাখার জন্য টিলার পদদেশে ঘর বানিয়ে ভূমিহীনদের কম ভাড়ায় বরাদ্ধ দেয়।
যদিও ২০১২ সালে সিলেটের পাহাড় টিলা সংরক্ষণে উচ্চ আদালতের এক রায়ে টিলার উপর ও পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করা দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে পুণবার্সনের নির্দেশনা দেয়া হয়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, সিলেটে নির্বিচারে পাহাড় টিলা কাটা হয়। পাহাড় কাটার কৌশল হিসেবে পাহাড়ের পাদদেশে নিম্নআয়ের মানুষের জন্য বসতি বানানো হয়। ঝুঁকি নিয়ে কয়েক হাজার মানুষ বাস করেন এসব পাহাড়-টিলার আশপাশে। ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাহাড় বা টিলাধসে একাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।'
তিনি বলেন, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর সিলেট সদর উপজেলায় টিলাধসে এক শিশুর মৃত্যু হয়। ২০২২ সালের ৬ জুন জৈন্তাপুর উপজেলায় একই পরিবারের চার জনের মৃত্যু হয়। পাহাড় বা টিলাধসে মানুষের মৃত্যু হলে প্রশাসন কিছুদিনের জন্য তৎপর হয়। তারপর আবার চুপ হয়ে যায়।
সিলেট নগরের হাওলাদারপাড়া এলাকার একটি টিলার নাম জাগো টিলা। উঁচু এই টিলার একেবারে কিনারা ঘেঁষে সারিবদ্ধভাবে কয়েকটি ঘর। উপরের ঘরগুলোর ঠিক নিচে, টিলার পাদদেশেও ঘর রয়েছে কয়েকটি। টিলার উপরে ও ঢালে বসবাস করা সবগুলো পরিবারের বাসিন্দারাই রয়েছেন ঝুঁকিতে। প্রাণের শঙ্কা নিয়েই বছরের পর বছর ধরে তারা বসবাস করে আসছেন এখানে।
জাগোটিলার উপর ঘর বানিয়ে বাস করা শামসুল ইসলাম বলেন, এটি সরকারি টিলা। ভাড়া দিতে হয় না। তাই আমরা এখানে ঘর বানিয়ে থাকি।
ঝুঁকি সম্পর্কে তিনি বলেন, ভয় তো আছেই। বৃষ্টি দিলে ভয় আরও বেড়ে যায়। কিন্তু আমরা গরীব মানুষ। জায়গা কেনার সামর্থ নেই। ঘর ভাড়া করাও অনেক খরচের। তাই ঝুঁকি নিয়েই এখানে থাকি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টিলার উপরে ও পাদদেশে বসবাসকারী বেশিরভাগ লোকজনই এরকম দরিদ্র। স্থানীয় প্রভাবশালীরা টিলা কাটা ও দখলের জন্য দরিদ্রশ্রেণির লোকজনদের বসিয়েছেন। আবার কম টাকায় পেয়ে টিলার পাদদেশে জমি কিনেও ঘর বানিয়েছেন অনেকে।
বাংলাদেশ পরিবশে আইনবিদ সমিতির (বেলা) হিসেব মতে, সিলেট নগর, সদর, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় প্রায় ৪শ পাহাড়-টিলা রয়েছে। এসব টিলার উপর ও পাদদেশে অনেক পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করে।
পরিবেশবাদী সংগঠন সেভ দ্যা হেরিটেজ এন্ড এনভায়রনমেন্ট’র প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হাই বলেন, আমরা বছর তিনেক আগে একটা জরিপ চালিয়ে দেখেছিলাম জেলায় টিলার পাদদেশে প্রায় ১০ হাজার পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাস করছেন। এখন এই সংখ্যা আরও অনেক বাড়বে।
তিনি বলেন, বসবাসের জন্য এসব টিলার অনেকাংশ কেটে ফেলায় টিলাগুলোও দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে এগুলো ধসে পড়ে প্রাণহাণির ঘটনা ঘটে।
অপরিকল্পিতভাবে টিলা কাটা, বৃক্ষ উজার ও টিলার পাদদেশে ঝুঁিকপূর্ণভাবে বসবাসের ফলে বৃষ্টি হলেই টিলা ধসে পড়ছে বলে মত এই পরিবেশকর্মীর।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরের হাওলাদারপাড়া, আখালিয়া, পীরমহল্লা ব্রাহ্মণশাসন জাহাঙ্গীরনগর, তারাপুর চা বাগান এবং নগরের উপকণ্ঠের বালুচর, বিমানবন্দর সড়ক, খাদিমপাড়া, খাদিমনগর, জোনাকী, ইসলামপুর মেজরটিলা, মংলিরপাড় এলাকায় বিভিন্ন টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে কয়েক শ’ পরিবার। এছাড়া জৈন্তাপুর, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় টিলা ও পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে সহস্রাধিক পরিবার।
টিলার পাদদেশে ঝুকি নিয়ে বসবাস ও প্রাণহানির জন্য প্রশাসনের গাফিলতিকে দায়ী করে বাংলাদেশ পরিবশে আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেটের সমন্বয়ব শাহ শাহেদা আক্তার বলেন, ২০১২ সালে আমাদের করা একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত সিলেটে পাহাড় টিলা কাটায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। একই সঙ্গে পাহাড় টিলা সংরক্ষণ ও তার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী দরিদ্র মানুষজনকে পুণবার্সসনের নির্দেশনা দেন। কিন্তু ওই রায়ের ১২ বছর পেরিয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হয়নি।
শাহেদা বলেন, কি পরিমান লোক ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করেন তারও কোন হিসেব নেই জেলা প্রশাসনের কাছে। তাদের পুনর্বাসন বা টিলা সংরক্ষণে সরকারি কোন উদ্যোগ বা প্রকল্প নেই। বরং টিলা ধ্বংস করে অনেক প্রকল্প আছে। সরকারের এই নিষ্ক্রিয়তার কারণেই বারবার এই দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটছে।
এই পরিবেশকর্মী আরও বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই টিলাখেকোরা টিলা দখল ও কাটার জন্য দরিদ্রশ্রেণির লোকজনদের স্বল্পভাড়ায় বা বিনাভাড়ায় টিলার উপরে ঘর নির্মাণ করে দেয়।
টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাকারীদের সরানো যায় না দাবি সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসানেরও। তিনি বলেন, টিলার উপরে ও পাদদেশে যারা বসবাস করেন চেষ্টা করেও তাদের অন্যত্র সরানো যায় না। গত বছরও আমরা সব ইউএনওদের মাধ্যমে মাইকিং করিয়ে টিলার পাদদেশে বসবাসকারীদের নিরাপদে সরে যেতে বলেছি। কিন্তু কেউ কথা শুনেনি।
তিনি বলেন, এটা একটা বড় সমস্যা। তাদের কিভাবে সরানো যায় ও পুণবার্সন করা যায় এনিয়ে ভাবছি। তাদের মধ্যে যদি কেউ ভ’মিহীন থেকে থাকেন তাহলে প্রশাসন বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে তাদের সরকারের আশ্রয়ন প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করা হবে।
সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি : নূরুর রশীদ চৌধুরী, সম্পাদক : ফাহমীদা রশীদ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক : ফাহমীনা নাহাস
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : অপূর্ব শর্মা