সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে কুশিয়ারা নদীতে অবৈধভাবে ড্রেজার মেশিন চালিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। যার ফলে চরম ঝুঁকিতে পড়েছে উপজেলার চান্দপুর-ইসলামবাজার-মানিকোনা -গোলাপগঞ্জ সড়ক, আশপাশের কবরস্থান ও সড়কের পাশের রেল সেতু।
অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে দুই উপজেলার লক্ষাধিক মানুষের যাতায়াতের একমাত্র এই সড়কটি বিভিন্ন অংশে ভাঙন দেখা দিয়েছে। মানিকোনা, গঙ্গাপুর, মল্লিকপুর, কুতুবপুরসহ আশপাশের অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের হেঁটে বা যানবাহনে যাতায়াতের একমাত্র সড়ক এটি। তাই বিপাকে পড়েছে এইসব এলাকার স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা। যানবাহন দূরের কথা পায়ে হেঁটে এই সড়ক দিয়ে যাওয়াই অনেক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে।
জানা যায়, পাহাড়ি ঢল নামলেই সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার কুরকুচি খাল ও কুশিয়ারা নদীর মুখে প্রচুর পলি পড়ে। পলি পড়ার কারণে পানি নামতে পারে না। যার ফলে এই খাল ও নদী সংলগ্ন সড়কটি ভেঙে যায়। গতবছর বন্যায় এই কারণে সড়ক ভেঙে যায়। তাই কুরকুচি খাল ও কুশিয়ারা নদীর মুখে পলি অপসারণের জন্য গতবছরই সংশ্লিষ্ট দপ্তরে একটি প্রস্তাবনা পাঠায় সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড। সেই প্রস্তাবনা এখনো অনুমোদন পায়নি। কিন্তু স্থানীয় এক বালু ব্যবসায়ী নদী খননের প্রস্তাব অনুমোদিত হওয়ার আগেই এই প্রকল্পের নামে ড্রেজার মেশিন বালু উত্তোলন শুরু করে দিয়েছেন।
তবে সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, নদীতে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন বৈধ নয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ করতে এক্সকেবেটরে মাধ্যমে করা হয়। যেহেতু কুরকুচি খাল ও কুশিয়ারা নদীর মুখে পলি অপসারণের প্রস্তাবনা এখনো অনুমোদিত হয়নি তাই এই জায়গা থেকে কোনোভাবেই এখন বালু তোলা যাবে না।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, গঙ্গাপুর গ্রামের ইমন আহমেদ নামে এক ব্যক্তি বালু ব্যবসা করেন। তিনি কুশিয়ারা নদীতে ড্রেজার মেশিন চালিয়ে বালু উত্তোলন করাচ্ছেন। গত মঙ্গলবার (৪ জুন) ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার ইসলামবাজার এলাকার কুশিয়ারা নদীতে ড্রেজার মেশিন, পাইপসহ আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদি বসান। তখন স্থানীয় কয়েকজন নদী থেকে বালু উত্তোলনে বাধা দিলে ইমন তাদের বলেন তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডের বরাদ্দের কাজ পেয়েছেন তাই বালু উত্তোলন করছেন সড়ক সংস্কারের জন্য।
স্থানীয়রা জানান, গত প্রায় সাত মাস আগে কুশিয়ারা নদীর মুখে শাখা নদী কুরকুচির খাল পারের সড়কটি ভেঙে যায়। এই সড়কটি ইসলামবাজার, মানিককোনা, গোলাপগঞ্জের যোগাযোগ সড়ক। ইসলামবাজার এলাকায় সড়কটি ভেঙে গিয়ে যোগাযোগ ব্যাহত হলে স্থানীয় গ্রামবাসীরা প্রায় ১৯ লাখ টাকা চাঁদা তুলে এই সড়কে কাজ করান। কিন্তু সম্প্রতি অতিবৃষ্টি ও বন্যার প্রকোপ বাড়লে আবারও সড়কটির অবশিষ্ট অংশও ভেঙে নদীতে চলে যায়। এই সড়কটি সংস্কারের জন্য গেল দেড় বছরেও সরাসরি কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কিন্তু গত কয়েকদিন থেকে সড়ক মেরামত নামে অপতৎপরতা চালাচ্ছে একটি বালুখেকোচক্র।
এদিকে গত ৬ জুন বৃহস্পতিবার উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহ জহুরুল হোসেন এই ড্রেজার মেশিন বন্ধ করে যান এবং এখানে ড্রেজার মেশিন না চালানোর জন্য নির্দেশ দিয়ে যান। কিন্তু অদৃশ্য কারণে পরের দিন ৭ জুন আবারো ড্রেজার চালিয়ে বালু উত্তোলন শুরু হয়। যা এখনো চলছে। কুরকুচি খালের মুখ ও কুশিয়ারা নদীর মোহনা থেকে বালু তোলে কবরস্থানের সামনে বালু রাখা হচ্ছে।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহ জহুরুল হোসেন বলেন, গত ৬ জুন অভিযোগ পেয়ে আমি গিয়ে মেশিন বন্ধ করে আসছি। আবারো চালানো হচ্ছে বলে জানি না। যদি তারা আবারও নদীতে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করেন তবে আমি আবার গিয়ে ব্যবস্থা নেব।
সরেজমিনে দেখা যায়, যেখানে ড্রেজার লাগানো হয়েছে এই জায়গাটিই নদী ভাঙনের শিকার। এখানে ড্রেজার দিয়ে বালু তোলে বস্তায় ভরে সড়কের ভাঙন ঠিক করার আগেই সড়কে আরও ধস নেমে যেতে পারে। এসময় নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয়রা বলেন, এখানে ড্রেজার চালু করার ফলে পানির তলদেশে যে ঘূর্ণি তৈরি হবে। তাতে সড়কের ভাঙনতো বাড়বেই সেই সাথে পাশের ব্রিটিশ আমলের তৈরি রেলব্রিজের খুঁটির মাটিও সরে গিয়ে ব্রিজটি চরম ঝুঁকিতে পড়বে। তাছাড়া কোন সেতুর এক কিলোমিটারের মধ্যে ড্রেজার চালানোই বে-আইনি। এই সড়কের পাশেই কয়েকটি কবরস্থান আছে যেগুলো ইতিমধ্যে ঝুঁকিতে আছে। কুরকুচি খাল পারের কবরস্থানটি যেকোনো সময় নদীতে চলে যাবে।
ইসলামবাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ভরা বন্যায় রাস্তা মেরামতের জন্য ড্রেজার চালানো আইনেও নাই। এখানে মূলত বালু ব্যবসার জন্য রাস্তার নাম ব্যবহার করা হচ্ছে। আমরা তো ভয়ে মুখ খুলতে পারি না। কোন অশিক্ষিত মানুষও বুঝবে এখানে ড্রেজার চললে ৩টি বড় ক্ষতির সম্ভাবনা বাড়বে। ভেঙে যাওয়া রাস্তা আরও ভেঙে মার্কেট, দোকানপাট বিলীন হবে, পাশের কবরস্থান নদীতে চলে যাবে, ও রেলসেতু দুর্বল হয়ে বড় অঘটন ঘটতে পারে। এই গ্রামের কবরস্থান বা মার্কেটের ক্ষতি হলে এখানে আইন শৃঙ্খলা অবনতি হবার সম্ভাবনাও রয়েছে।
এদিকে, কুশিয়ারা নদীর ওপর রেলসেতুটি ঢাকা-সিলেট রেলপথের দ্বিতীয় দীর্ঘতম সেতু। এ সেতুটির দেখভালে বিশেষ নির্দেশনাও রয়েছে। মাইজগাঁও রেলস্টেশন সূত্রে জানা গেছে, রেলসেতুর এক কিলোমিটারের মধ্যে ড্রেজার চালানো বে-আইনি। রেলস্টেশন থেকে বলা হয়েছে, এ বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করা হয়েছে।
বালু উত্তোলনকারী ইমন আহমেদ বলেন, ইসলামবাজার রাস্তা পুরোপুরি ভেঙে গেছে। এই রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলাচল ও মানুষজনের হাঁটার জন্য আমরা নদী থেকে বালু উত্তোলন বস্তায় ভর্তি করে সড়কের পাশে দেব।
সড়ক সংস্কারে সরকারি কোনো প্রকল্পের অনুমোদন পেয়েছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমারা স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের সাথে কথা বলে এই কাজ করছি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনুমোদন আছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড এধরনের কোনো বরাদ্দ দেয়নি ও উপজেলা প্রশাসনের কোনো অনুমোদন দেয়নি বলে নিশ্চিত করেছে, তারপরও আপনি কেন ড্রেজার দিয়ে নদী থেকে বালু তুলছেন-এ প্রশ্নে ইমন আহমেদ কোনো উত্তর দিতে পারেননি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার শাখার কর্মকর্তা উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. গোলাম বারী বলেন, ‘নদী খননের জন্য আমরা একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছি। এখনো এই প্রকল্পের অনুমোদন হয়নি। এটা এ সপ্তাহের মধ্যে অনুমোদন হয়ে যাবে। স্থানীয় এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও মহোদয় বলছেন আমাদের প্রকল্প অনুমোদনতো হবেই, ইসলামপুর বাজার যেহেতু ভেঙে যাচ্ছে তাই কাজ করতে। এ ইসলামপুর বাজার ইতোমধ্যে ভেঙে গেছে।’
প্রকল্প অনুমোদনের আগে প্রকল্প কাজ কী করে শুরু হলো-এ প্রশ্নে পাউবোর উপসহকারী বলেন, আগের বছর ভাঙন এপ্রিল মাসের দিকে হয়েছিল হঠাৎ করে হাওরে পানি ছেড়ে দেওয়ার জন্য। আমরা তখনই প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম। এটা এখন অনুমোদন হবে। শুধুমাত্র ডিজি স্যারের স্বাক্ষর বাকি আছে।’
নদীতে ড্রেজার লাগিয়ে বালু উত্তোলন অবৈধ জানিয়ে পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী মো. গোলাম বারী আরও বলেন, ‘প্রকল্পের জন্য আমাদের বালু প্রয়োজন।কিন্তু বালু তোলার কারণে রেলসেতুর ক্ষতি হোক-এটা আমরা চাই না। তবে আমরা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, এ মৌসুমে এখান থেকে পলি অপসারণ সম্ভব না। এ কাজ শুষ্ক মৌসুমে করা লাগবে। তাছাড়া নদীতে ড্রেজার মেশিন লাগিয়ে বালু উত্তোলন অবৈধ। তাই যেকোনো কাজের জন্যই কেউ যদি নদীতে ড্রেজার মেশিন লাগিয়ে বালু উত্তোলনের অভিযোগ আমরা পাই তাহলে এ ব্যাপারে পাউবো ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি : নূরুর রশীদ চৌধুরী, সম্পাদক : ফাহমীদা রশীদ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক : ফাহমীনা নাহাস
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : অপূর্ব শর্মা