• ১২ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ২৭শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ১০ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

পালিয়ে যেতে পরামর্শদাতা কে সেই সিনিয়র কর্মকর্তা ?

Daily Jugabheri
প্রকাশিত নভেম্বর ১০, ২০২০
পালিয়ে যেতে পরামর্শদাতা কে সেই সিনিয়র কর্মকর্তা ?

বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে যুবক হত্যা
আকবর গ্রেপ্তার হলেও অনেক প্রশ্ন
সজল ছত্রী ::::
অবশেষে গ্রেপ্তার হয়েছেন সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে নিহত যুবক রায়হান আহমদকে হত্যায় প্রধান অভিযুক্ত ও বহিস্কৃত এসআই আকবর হোসেন ভূইয়া। সোমবার দুপুরে কানাইঘাট উপজেলার লক্ষ্মীপ্রসাদ ইউনিয়নের সীমান্ত এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে দাবি করেছে সিলেট জেলা পুলিশ। সন্ধা ৬ টায় সিলেট জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তাকে হাজির করার পর রাতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর কাছে হস্তান্তর করা হয়। আজ (মঙ্গলবার) তাকে আদালতে হাজির করে রিমান্ড চাইবে বলে জানিয়েছে পিবিআই সিলেটের পুলিশ সুপার খালেদ উজ জামান।
এদিকে ঘটনার ২৮ দিন পর আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হলেও দেখা দিয়েছে নতুন অনেক প্রশ্ন। আকবর ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলেন কিনা, কিংবা কারা তাকে পালিয়ে যেতে পরামর্শ ও সহযোগিতা করেছিল তা নিয়ে দেখা দিয়েছে নতুন প্রশ্ন।
আকবরকে গ্রেপ্তারের পর সংবাদ সম্মেলনে সিলেটের পুলিশ সুপার মো. ফরিদ উদ্দিন এবং সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মো. মফিজ উদ্দিন আহমদ জানান, হত্যাকা-ের তিন দিন পর থেকে পলাতক আকবরকে গ্রেপ্তারে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। বারবার স্থান পরিবর্তন করার কারণে তার অবস্থান সনাক্ত করা সম্ভব কঠিন হচ্ছিল। কিন্ত তাকে আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা হিসেবে যারই নাম পাওয়া গেছে তাকে আটক বা জিজ্ঞাসাবাদের প্রক্রিয়া চালানো হয়েছে। অবশেষে বিশ^স্ত কিছু সোর্সের মাধ্যমে সোমবার সকাল নয়টায় তাকে কানাইঘাট সীমান্ত এলাকার ডোনা বস্তি থেকে আটক করা হয়।
পুলিশ এমন দাবি করলেও সোমবার দুপুরের আগেই দুটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হতে দেখা যায়। যার একটিতে দেখা যায়, আকবরকে আটক করে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করছে আদিবাসী খাসিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন। তারা তাকে বেঁধে একটি পাহাড়ি ছড়ার ভেতর দিয়ে নিয়ে আসতে যায়। পরে তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
খাসিয়া সম্প্রদায়ের হাতে আটকের পর আকবর নিজের পরিচয় আড়াল করার চেষ্টা করেন। নিজের বেশভূষায়ও বেশ পরিবর্তন আনেন তিনি। গলায় বেলমালা পরে হিন্দু সাজার চেষ্টাও করেন। খাসিয়াদের বারবার জিজ্ঞাসাবাদে নিজের পরিচয় দিতে বাধ্য হলেও রায়হানকে খুন করেননি বলে দাবি করেন আকবর। এসময় তিনি বলেন, আমি একা কিছু করিনি। পাঁচ-ছয়জন মিলে রায়হানকে মারছিল। এজন্যে মরে গেছে।’
খাসিয়া সম্প্রদায়ের এক লোক তখন জিজ্ঞেস করেন, ‘তাহলে তুমি কেন পালিয়ে গেলে?’ এমন প্রশ্নের জবাবে আকবর বলেন, ‘আমাকে সাসপেন্ড করা হয়। এরেস্ট হতে পারি বলেও জানানো হয়। তখন আমাকে সিনিয়র কর্মকর্তারা বলেছিলেন পালিয়ে যেতে। দু মাস পালিয়ে থাকলে সিনিয়র কর্মকর্তারা বিষয়টি হ্যান্ডেল করতে পারবেন বলে আশ^স্ত করা হয়। সেজন্যই পালিয়ে যাই, তা না হলে পালনোর ইচ্ছে ছিল না।’
তবে সিনিয়র কর্মকর্তাদের নাম বলেননি আকবর। এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হলে সিলেটের পুলিশ সুপার মো. ফরিদ উদ্দিন এই ভিডিওর ব্যাপারে কিছু জানেন না বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ভারতে পালানোর সময় কানাইঘাটের লক্ষ্মীপ্রসাদ সীমান্ত এলাকা থেকে আকবরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রোববার রাত থেকে তাদের কাছে তথ্য ছিল যেকোনো সময় এসআই আকবর ভারতে পালিয়ে যেতে পারেন। তাই সাদাপোশাকে পুলিশ সীমান্ত এলাকায় আগে থেকেই অবস্থান নেয় এবং একদিন পর সোমবার তাকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় জেলা পুলিশ। হতে পারে ভারত পালিয়ে থাকার পর সে দেশে প্রবেশের চেষ্টা করছিল। সেটা পরবর্তী জিজ্ঞাসাবাদে জানা যাবে। একই সাথে কারো পরামর্শে সে পালিয়েছিল কিনা সেটাও জানা যাবে।
এ বিষয়ে সিলেট মহানগর পুলিশের নবনিযুক্ত কমিশনার নিশারুল আরিফের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, অপরাধি নিজের দোষ ঢাকতে অন্যের নাম নিতে পারে। তবে বিষয়টি ক্রশচেক করে দেখা হবে। কেউ দায়ি হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
১১ অক্টোবর ঘটনার পর থেকেই বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িকে ঘিরে ফাঁড়ি ইনচার্জ এসআই আকবরের অপরাধজগতের নেপথ্যে মহানগর পুলিশের এক বা একাধিক সিনিয়র কর্মকর্তার প্রশ্রয় রয়েছে বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ওঠে আসে। তাকে সাসপেন্ড করার পর নজরদারিতে না রাখার গুরুতর অভিযোগও ওঠে। তবে এখন পর্যন্ত এ মামলায় দুই এএসআই ও ছয় কনস্টেবলকে সাময়িক বহিস্কার ও প্রত্যাহার করা ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি মহানগর পুলিশ। পুলিশ সদর দপ্তরের একটি দল সিলেট এসে পুলিশ সদস্যদের গাফিলতি ও যোগসাজশের বিষয়টি তদন্ত করলেও এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। বিষয়টি ঘটনার পর পরই মহানগর পুলিশ কমিশনার গোলাম কিবরিয়াকে সিলেট থেকে সরানো হয়। নতুন কমিশনার হিসেবে যোগ দেন নিশারুল আরিফ।
অন্যদিকে মহানগর পুলিশের হাত থেকে মামলাটি পিবিআইয়ে হস্তান্তরের পর ঘটনার রাতে প্রত্যক্ষদর্শী তিন কনস্টেবল শামীম, দেলোয়ার ও সাইদুরের আদালতে জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়। তাদের জবানবন্দির সূত্র ধরে একে একে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এএসআই আশেক এলাহি, কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাস ও হারুনুর রশীদকে। তবে তারা রিমান্ডে মুখ খুলেনি, আদালতেও দেননি কোনো জবানবন্দি। এর মধ্যে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক মহিদুল ইসলামসহ তদন্ত টিমের ৫ সদস্য করোনা আক্রান্ত হলে হতাশা নেমে আসে নিহত রায়হানের পরিবারে। তারা বিচার দাবি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
প্রসঙ্গত, গত ১০ অক্টোবর শনিবার মধ্যরাতে রায়হানকে নগরীর কাষ্টঘর থেকে ধরে আনে বন্দরবাজার ফাঁড়ি পুলিশ। পরদিন ১১ অক্টোবর ভোরে ওসমানী হাসপাতালে তিনি মারা যান। রায়হানের পরিবারের অভিযোগ, ফাঁড়িতে ধরে এনে রাতভর নির্যাতনের ফলে রায়হান মারা যান। ১১ অক্টোবর রাতেই রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার বাদি হয়ে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে মামলা করেন।
এরপর সিলেট মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) মো. আজবাহার আলী শেখের তত্ত্বাবধানে মহানগর পুলিশের তিন সদস্যের একটি অনুসন্ধান কমিটি তদন্ত করে ফাঁড়িতে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর বিষয়ে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়। সিলেট পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে লাগানো সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায় রাত তিনটায় বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে সুস্থাবস্থায় নিয়ে আসা হয় রায়হানকে। সকাল ছয়টায় অসুস্থাবস্থায় তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। এ ঘটনায় ১২ অক্টোবর ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত ও তিনজনকে ফাঁড়ি থেকে প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু পুলিশ নজরদারি থেকেই পালিয়ে যান প্রধান অভিযুক্ত এসআই আকবর। তাকে পালানোতে সহায়তা ও তথ্য গোপনের অভিযোগে ২১ অক্টোবর ফাঁড়ির আরেক এসআই হাসানকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
সেসময় একাধিক সূত্রে জানা যায়, ঘটনার দুইদিন পরই আকবর সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ভারতের মেঘালয়ে পালিয়ে যান।
মহানগর পুলিশের গাফিলতি ধরা পরার পর গত ১৩ অক্টোবর মামলাটি পিবিআইতে হস্তান্তর করা হয়। ১৫ অক্টোবর পুনরায় ময়নাতদন্তের জন্য রায়হানের মরদেহ কবর থেকে তোলা হয়। তদন্তে জানা যায় উপযুপরি আঘাতে মৃত্যু হয়েছে রায়হানের।
পিবিআই এ ঘটনায় চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। এদের মধ্যে কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাস ও হারুন উর রশিদকে দুই দফায় ৮ দিন ও সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আশেক এলাহীকে ৫ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। তবে তারা কেউ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে সম্মত হননি। এছাড়া রায়হানের বিরুদ্ধে ছিনতাইয়ের অভিযোগকারী সাইদুর শেখ নামের এক ব্যক্তিকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন