সামিয়ান হাসান, বিয়ানীবাজার : সাধারণ মানুষের কাছে আশীর্বাদ হয়ে এলো ব্যাংকের উপশাখা। স্থানীয় হাটবাজার বা বাড়ির কাছে ব্যাংকের স্থাপিত এসব উপশাখায় ব্যাংক হিসাব খোলা, টাকা জমা ও উত্তোলন, আমানত রাখা, ঋণসুবিধা, ইউটিলিটি বিল জমাসহ প্রায় সব ধরনের ব্যাংকিং সেবা পাওয়া যাচ্ছে এখান থেকে। বিয়ানীবাজার উপজেলায় এ পর্যন্ত ১০টি ব্যাংকের উপশাখা স্থাপন করা হয়েছে। চারখাই, দুবাগ, মাথিউরা, বালিঙ্গাসহ অন্যান্য বড় হাট-বাজারে এসব উপশাখা স্থাপন করছেন উদ্যোক্তারা।
জানা যায়, ব্যাংকের উপশাখা স্থাপনের কারণে প্রতিদিনই বাড়ছে নতুন গ্রাহক আমানত ও ঋণ বিতরণের পরিমাণ। অন্যদিকে ব্যবস্থাপনা খরচ কম হওয়ায় ব্যাংকগুলোও উপশাখা স্থাপনের প্রতি দিন দিন আগ্রহী হয়ে উঠছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, উপশাখার মাধ্যমে কম খরচে আর্থিক সেবার বাইরে থাকা সাধারণ মানুষের কাছে সরাসরি ব্যাংকের সেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। আবার গ্রাহকদের ওপর কোনো ধরনের বাড়তি ফি বা চার্জ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। ফলে উপশাখার সেবা দিন দিন প্রসার ও জনপ্রিয় হচ্ছে। স্থানীয়ভাবে অনেক যুবকদের কর্মসংস্থান হচ্ছে। শিক্ষিত-অল্পশিক্ষিত যুবকরাও এসব উপশাখায় কাজ করছেন। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দ্রুত বাড়ি-বাড়ি পৌছে দেয়া হচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপশাখা হলো ব্যাংকের শাখার আদলে ছোট পরিসরের ব্যবসাকেন্দ্র যা আগে ব্যাংকিং বুথ নামে পরিচিত ছিল। এটি নিকটবর্তী কোনো শাখার অধীনে পরিচালিত হয়। উপশাখায় সর্বোচ্চ ১০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করছেন। তবে কোনো কোনো উপশাখা দুই-তিনজন কর্মকর্তাও চালাচ্ছেন। কম লোকবল ও সাজসজ্জার কারণে খরচও কম। এর ফলে ব্যাংকগুলো উপশাখা স্থাপনে দিন দিন আগ্রহী হয়ে উঠছে। উপশাখায় বৈদেশিক বাণিজ্যিক কার্যক্রম ছাড়া ব্যাংকের সব ধরনের সেবা দেওয়া হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বর্তমানে উপজেলা ও থানা পর্যায়ে বিভিন্ন ব্যাংকের শাখা রয়েছে। তবে উপজেলা ও থানা পর্যায়ে ব্যাংকের শাখা থাকলেও তা সাধারণত উপজেলা বা থানার হেড কোয়ার্টার অথবা প্রধান ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। ফলে ওই উপজেলার দূরবর্তী অঞ্চলের লোকজন ব্যাংকিং সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। কারণ ১০-২০ কিলোমিটার দূর থেকে ব্যাংকে যাওয়া সব সময় সব মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না। এ সমস্যা সমাধানে উপশাখা ব্যাংকিং এখন কার্যকরী ভূমিকা রাখছে।
এ বিষয়ে বিয়ানীবাজারের ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপক গওহর আলতাফ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা একটি শাখা খুলে যে বেনিফিট পাই, মোটামুটি একই রকম বেনিফিট উপশাখা খুলেও পাচ্ছি। এর মাধ্যমে কম খরচে ব্যাংকের নেটওয়ার্কও বিস্তৃত করা সম্ভব হচ্ছে। আবার শাখার মতো প্রায় সব ধরনের সেবা পাওয়ায় গ্রাহকদের জন্যও সুবিধা হচ্ছে। তাঁদের সরাসরি ব্যাংকের সেবা নেওয়ার জন্য বেশি দূরে যাওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না। এতে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিও ত্বরান্বিত হচ্ছে।’
সাউথ ইষ্ট ব্যাংকের জোনাল অফিসের একজন উর্দ্ধতন কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকের পক্ষে সব জায়গায় শাখা খোলা সম্ভব না। আবার সব জায়গায় খুললে লাভের মুখ দেখতে পারবে কি না সেটিও বড় বিষয়। তাই যেসব জায়গায় ব্যাংক শাখা দিতে পারছে না বা শাখা খোলা অলাভজনক, কিন্তু জনগণকে ব্যাংকিং সুবিধার আওতায় আনা প্রয়োজন ওই সব এলাকার মানুষকে আর্থিক সেবায় আনার ক্ষেত্রে উপশাখা ভূমিকা রাখছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোও মানুষের আরো দোরগোড়ায় ব্যাংকিং সেবা নিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছে। এতে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ত্বরান্বিত হচ্ছে। অন্যদিকে কর্মসংস্থানও বাড়ছে।
ব্যাংকগুলোওর উপশাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, উপশাখায় সব রকম ব্যাংক হিসাব খোলা, নগদ টাকা জমা ও উত্তোলন, চেকবই এবং পে অর্ডার ইস্যু, ক্লিয়ারিং চেক ও পে অর্ডার জমা, আমানত ও ঋণসুবিধা, রিয়েল টাইম অনলাইন ব্যাংকিং সুবিধা, ইউটিলিটি বিল জমাসহ সব ধরনের ব্যাংকিং সেবা প্রদান করা হয়। ব্যাংকের গ্রাহক ভিত্তি দেশব্যাপী সম্প্রসারণ করা, ব্যাংকিং আওতাবহির্ভূত এলাকার জনগণের নিরাপদ সঞ্চয়ের সুযোগ সৃষ্টি, বৈদেশিক রেমিট্যান্সের অর্থ সহজে ও দ্রুততম সময়ে সুবিধাভোগীর কাছে পৌঁছানো, পশ্চাৎপদ এলাকার অর্থায়নের মাধ্যমে স্থানীয়পর্যায়ে অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আধুনিক ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবাকে তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়াও উপশাখার অন্যতম কাজ হিসেবে বিবেচিত বলেও জানান তাঁরা।
বিয়ানীবাজার উপজেলার মাথিউরা পশ্চিমপার এলাকার বাসিন্দা ফখরুল ইসলাম। তাঁর বাসার কাছেই উপশাখা খুলেছে ইসলামী ব্যাংক। ফখরুল ইসলাম বলেন, বাড়ির কাছাকাছি হওয়ায় উপশাখায় একটি সঞ্চয়ী হিসাব খুলেছি। কোনো ঝামেলা ছাড়াই প্রতি মাসেই সঞ্চয়ের টাকা জমা করি। এতে আমার সময় যেমন বেঁচে যায়, তেমনি কোনো যাতায়াত খরচও লাগে না।
উপজেলার বালিঙ্গায় স্থাপিত এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের উপ-শাখার উদ্যোক্তা বলেন, উপশাখার ধারণাটি আগে ছিল না। এক-দুই বছর আগে এটা খোলার পারমিশন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মাধ্যমে কম খরচে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেতে পারছে ব্যাংকগুলো। ফলে লোকেশন বেশি কভার করা যাচ্ছে। এতে গ্রাহকদেরও সুবিধা হচ্ছে।
তিনি বলেন, উপশাখা থেকে প্রান্তিক কৃষক, খামারি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বেশি উপকৃত হচ্ছেন। কারণ তাঁরা উপশাখা থেকে সহজেই ঋণ নিতে পারছেন। শাখার নেটওয়ার্ক বিস্তৃত না থাকায় বা নেটওয়ার্কে কভার না করায় বেসরকারি ব্যাংকগুলো সরাসরি প্রান্তিক কৃষকের কাছে ঋণ বিতরণ করতে পারত না। কিন্তু উপশাখার কল্যাণে সেটি সম্ভব হচ্ছে। তাঁর মতে, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের তুলনায় উপশাখার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ উপশাখার মাধ্যমে সরাসরি ও তাৎক্ষণিক ব্যাংকের সব সেবা পাওয়া সম্ভব, যা এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সম্ভব না।