যুগভেরী রিপোর্ট :::
মাত্র দুদিনের বিদ্যুৎহীনতার সিলেটবাসী দেখলো জলাশয়ের কী প্রয়োজন। কুমারগাও বিদ্যুৎ কেন্দ্রে অগ্নিকা-ের পর নগরীর টিকে থাকা অল্প কটি পুকুর থেকে পানি সংগ্রহে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে নগরবাসীর মধ্যে। পরিবেশবাদীরাও বারবার সতর্ক করছেন এ বিষয়ে কিন্তু কারো কোনো রা নেই। খোদ সিটি কর্পোরেশন ভরাট করছে পুকুর। তাদের সাথে এবার যোগ দিয়েছে গণপূর্ত অধিদপ্তরও।
নগরের আরেকটি বড় পুকুর ভরাট করে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের আপত্তি সত্ত্বেও খোদ আরেক সরকারি প্রতিষ্ঠান গণপূর্ত অধিদপ্তর পুকুরটি ভরাটের কাজ শুরু করেছে। সিলেট নগরের ২৭ নং ওয়ার্ডের আলমপুরে এক একর ৯৮ শতকের এই পুকুরটি ভরাট করে নিজেদের কার্যালয় নির্মাণ করতে চায় গণপূর্ত অধিদপ্তর।
এরআগে গত মাসে সিলেট সিটি করপোরেশন নগরের ১৯ নং ওয়ার্ডের রায়নগর সোনারপাড়া মসজিদের পুকুরটি ভরাট করে ফেলে। এই পুকুর ভরাটের রেশ না কাটতেই আলমপুরে নিজেদের মালিকানাধীন পুকুরটি ভরাট করার উদ্যোগ নিয়েছে গণপূর্ত।
পুকুর ভরাটের বিষয়টি নজরে আসার পর তদন্তে নামে পরিবেশ অধিদপ্তর। তদন্তে পুকুর ভরাটের প্রাথমিক সত্যতা পায়। এরপর গত ৫ নভেম্বর গণপূর্ত অধিদপ্তর সিলেট জোনের নির্বাহী প্রকৌশলীকে পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয় থেকে একটি নোটিশ প্রদান করা হয়। এতে পরিবেশগত ক্ষতিসাধনের ব্যাপারে ১১ নভেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তরের সিলেট কার্যালয়ে শুনানিতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।
পরিবেশ অধিদপ্তরের নোটিশে উল্লেখ করা হয়, গত ৫ নভেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয় কর্তৃক আপনার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে এনফোর্সমেন্ট পরিচালনা করা হয়। এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রম পরিচালনার সময় পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি ব্যতীত পুকুর ভরাটের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা উদঘাটন করা হয়। যা বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত-২০১০) ও পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ১৯৯৭ (সংশোধিত-২০০২) এর পরিপন্থী ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যালয়ে ১১ নভেম্বর শুনানিতে হাজির হওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের এই নির্দেশনার পর গত ৯ নভেম্বর পুকুরের এক অংশে বালু ফেলে টেস্টিং ল্যাবরেটরি নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে গণপূর্ত অধিদপ্তর। ওইদিন ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম।
প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইনে কোনো পুকুর, জলাশয়, নদী, খাল ইত্যাদি ভরাট করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আইনের ৫ ধারা অনুযায়ী, প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন বা অন্য কোনো ধরণের ব্যবহার, ভাড়া, ইজারা বা হস্তান্তর বেআইনি। যদি কোনো ব্যক্তি এই আইন লঙ্ঘন করেন তবে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের দাবি, এই জায়গায় কোনো পুকুর ছিলো না। নিচু ভূমি হওয়ায় কিছু পানি জমেছে। তবে পরিবেশ কর্মী ও স্থনীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, এখানে দীর্ঘদিন ধরেই পুকুর রয়েছে। এই পুকুরের কিছু অংশ ভরাট করেই কয়েকবছর আগে সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিস নির্মাণ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে গণপূর্ত অধিদপ্তর সিলেট জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী রিপন কুমার রায় বলেন, এখানে কখনোই পুকুর ছিল না। নিম্নাঞ্চল হওয়াতে এখানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। ইট ভাটার জন্য এই জায়গাটি ক্রয় করা হয়েছিল।
পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশনা সম্পর্কে তিনি বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে শুনানিতে অংশগ্রহণের জন্য বলা হয়েছিল। তারা এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত দেননি।
যদিও সিটি করপোরেশনের ২৭ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আজম খান বলছেন, এই জায়গায় আমার জন্মের আগে থেকেই পুকুর ছিলো। স্থানীয় জনগণ গণপূর্তের সাথে চুক্তির মাধ্যমে এই পুকুরে মাছ চাষ করেন। সম্প্রতি দেখেছি ভবন নির্মাণের জন্য এখানে সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। পুকুর ভরাট করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। তার উপর সিলেট নগরীতে এখন পুকুরের সংখ্যা অনেক কমে গেছে।
তিনি বলেন, আমি মেয়র মহোদয়ের সাথে কথা বলে দেখবো এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যায় কি না।
সরজমিনে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নগরীর ২৭নং ওয়ার্ডের আলমপুরে অবস্থিত গণপূর্তের মালিকানাধীন পুকুরের একপাশে ‘অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সিলেট গণপূর্ত জোনের কার্যালয় ও বাসভবনের জন্য নির্ধারিত স্থান’ লিখে সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। এবং পুকুরের আরেকপাশ ভরাট করে টেস্টিং ল্যাবরেটরির ভিত্তিপ্রস্তরের ফলক স্থাপন করা হয়েছে।
জানা যায়, গণপূর্ত অধিদপ্তর সিলেট জোনের ২টি স্থাপনা নির্মাণের জন্য এই পুকুর ভরাটের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একটি- অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সিলেট জোনের কার্যালয় ও বাসভবন নির্মাণ। অপরটি হচ্ছে- সিলেট গণপূর্ত জোনের টেস্টিং ল্যাবরেটরি নির্মাণ।
এদিকে পুকুর ভরাটের বিষয়ে স্থানীয়দের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) এর পক্ষ থেকে গত ১৫ নভেম্বর এই পুকুরটি পরিদর্শন করা হয়। পরিদর্শনকালে তারা দেখতে পান বিশাল পুকুরটি ভরাট করা হচ্ছে। পরিদর্শনের পর গত ১৬ নভেম্বর গণপূর্ত অধিদপ্তর সিলেট জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী বরাবর চিঠি দিয়ে পুকুরটি ভরাট না করার অনুরোধ জানায় বেলা। এরআগে ২০১২ সালেও এই পুকুরটি পরিদর্শন করে ভরাট না করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল বলে জানান বেলা সিলেটের সমন্বয়ক।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ্ সাহেদা আখতার বলেন, এই পুকুরটি ভরাট না করার জন্য এর আগে ২০১২ সালে আমার ওই জায়গা পরিদর্শন করি এবং মৌখিক ভাবে তাদেরকে পুকুরটি ভরাট না করার জন্য অনুরোধ করি। সম্প্রতি আবারও আমরা স্থানীয়দের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে ওই পুকুরটি পরিদর্শন করেছি। সেখানে গিয়ে দেখতে পাই পুকুরের একাংশ ভরাট করে গণপূর্ত অধিদপ্তরের ল্যাবরেটরি ভবন নির্মাণের জন্য ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেছেন। পুকুর ভরাট করা জলাধার আইন পরিপন্থী। এখন একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা যদি সরকারের আইন না মানে এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা বেআইনি কার্যক্রমকে আরও উৎসাহিত করবে বলে মনে করি। আমার আশা করি গণপূর্ত এই ধরনের বেআইনি উদ্যোগ গ্রহণ করা থেকে সরে আসবে।
পুকুর ভরাট প্রসঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট কার্যালয়ের পরিচালক মোহাম্মদ এমরান হোসেন বলেন, এই পুকুরটি ভরাট সংক্রান্ত বিষয়ে গণপূর্তের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে নোটিশ করা হয়েছিল। ১১ তারিখে তারা শুনানিতে অংশগ্রহণ করেছেন। তবে নোটিশ জারির পর শুনানিতে অংশ নেওয়ার আগেই তারা পুকুরের কিছু জায়গা বালু ফেলে ভরাট করে ফেলেছেন। এখানে কোনো পুকুর ছিলো না বলেও দাবি করছেন তারা। আগামী শুনানিতে তাদেরকে জমির রেকর্ড ও কাগজপত্র নিয়ে আসতে বলা হয়েছে। জেলা সমন্বয় সভায়ও এ বিষটি উত্থাপন করা হয়েছে।
সরকারি প্রতিষ্ঠানই যদি আইন না মানে তবে জনগণ কীভাবে মানবে এমন প্রশ্ন রেখে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, এমনিতেই সিলেট নগরীর ঐতিহ্যবাহী পুকুরগুলো অস্থিত্ব সংকটে পড়েছে। এখন যদি নিম্নাঞ্চল, পুকুর, জলাশয় ভরাট বন্ধ না করা হয় তাহলে সিলেটের পরিবেশ আরও সংকটাপন্ন হবে। এর আগে সিলেট সিটি করপোরেশন পুকুর ভরাট করেছে। এখন সরকারি প্রতিষ্ঠান গণপূর্তও একই পথে হাঁটছে।