• ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ২১শে মহর্‌রম, ১৪৪৬ হিজরি

সিলেট বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র : প্রাণীগুলো বাঁচবে কিভাবে?

Daily Jugabheri
প্রকাশিত আগস্ট ১০, ২০২১
সিলেট বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র : প্রাণীগুলো বাঁচবে কিভাবে?

যুগভেরী রিপোর্ট
বড় কয়েকটা ত্রিপলী দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে পুরো খাঁচা। আকাশও ঢাকা ত্রিপলী দিয়ে। দেখলে মনে হবে সংস্কার কাজ চলছে বোধহয়।
সিলেটের টিলাগড় এলাকার সিলেট বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেলো এমন দৃশ্যের। আদতে সংস্কার কাজ নয়, এই খাঁচার ভেতরে আছে রয়েছে বিদেশ থেকে নিয়ে আসা বিভিন্ন জাতের পাখি। ম্যাকাও, লাভ বার্ড, বাজিগর, চুকার পেকটিসসহ বিভিন্ন জাতের ১০টি পাখি রয়েছে এখানে।
সংরক্ষণ কেন্দ্রের আরেকটু ভেতেরে গিয়ে এরকম পর্দানশীল খাঁচা দেখা গেলো আরও কয়েকটা। দুটি ময়ূর রাখা হয়েছে যে খাঁচার মধ্যে, সেটি ঢাকা ত্রিপলী দিয়ে। অজগরের খাঁচাও একইভাবে ঢাকা। আলো-বাতাসও প্রবেশ করতে পারছে না।
প্রাণীদের ভেতরে রেখে খাঁচাগুলো এভাবে ঢেকে রাখা হয়েছে কেনো?- বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রের কর্মী আব্দুল কাদির দিলেন এক অদ্ভ’ত যুক্তি।
তিনি বলেন, করোনা সংক্রমণের কারণে এখানে মানুষজনের প্রবেশ বন্ধ রাখা হয়েছে। তারপরও সংরক্ষণ কেন্দ্রের ভেতরের সড়ক দিয়ে এলাকার অনেকে যাতায়াত করে। তারা অনেকসময় পাখি ও প্রাণীদের বিরক্ত করে। তারা যাতে এগুলো দেখতে না পারে তাই ত্রিপলী দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে।
এই বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রটি বনবিভাগের নিয়ন্ত্রণাধিন। এখানকার প্রাণীগুলো এভাবে আলোবাতাসহীনভাবে ঢেকে রাখার বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানিয়েছেন বন বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তা। আর পরিবেশকর্মীরা বলছেন, এখাবে ঢেকে রাখার কারণে প্রাণীদের বিকাশ বাধাগ্রস্থ হবে। এমনকি মারাও যেতে পারে।
এই প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র নিয়ে অব্যবস্থপনার অভিযোগ শুরু থেকেই। অব্যবস্থাপনা ও অপরিকল্পনার কারণে এখানকার বেশিরভাগ প্রাণীই ইতোমধ্যে মারা গেছে। বাকীগুলোও জীর্ণ হয়ে পড়েছে।
জানা যায়, ২০১৮ সালের ২ নভেম্বর সিলেট নগরীর টিলাগড় ইকোপার্কে এই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র চালু করা হয়। এরআগে এখানে নিয়ে আসা হয় ৯ প্রজাতির ৫৮টি প্রাণী।
তবে ইতোমধ্যে অজগর-ময়ূরসহ এখানকার অন্তত ৩০টি প্রাণী মারা গেছে।
সিলেট বন্যপ্রাণী সংরক্ষন কেন্দ্রে দায়িত্বরতদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বনের ভিতরে অবাদে গাড়ি প্রবেশের কারণেই মারা যাচ্ছে এখানকার প্রাণী। যানবাহানের অবাধ যাতায়াতে শব্দ ও বায়ু দূষণেই প্রাণীর মৃত্যু ঘটছে। তবে করোনা সংক্রমণের পর যানবাহন চলাচল কমায় প্রাণী মৃত্যু কমেছে বলে দাবি তাদের।
করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ায় গত বছরের মার্চ থেকে এখানে দর্শনার্থী প্রবেশ বন্ধ রয়েছে।
বর্তমানে এখানে বভিন্ন জাতের পাখি, অজগর, দুটি ময়ুর, জেব্রা, হরিণ, খরগোশসহ কিছু প্রাণী রয়েছে।
গত শুক্রবার বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, কেন্দ্রের মূল ফটক বন্ধ রয়েছে। কোনো দর্শনার্থী প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। তবে সংরক্ষণ কেন্দ্রের ভেতরের সড়ক দিয়ে পাশ^বর্তী এলাকার বাসন্দিারা অবাদে যাতায়াত করছেন।
কেন্দ্রের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, হরিণ ও জেব্রা ছাড়া সবগুলো প্রাণীর খাঁচা ত্রিপলী দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। বাইরে থেকে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
এ ব্যাপারে সিলেট বণ্যপ্রাণী সংরক্ষন কেন্দ্রের অস্থায়ী প্রাণীশালা রক্ষক মো. মাসুদ হাওলাদার বলেন, দর্শনার্থীদের প্রবেশ বন্ধ রাখতে ও স্থানয়দের উৎপাত থেকে রক্ষা করতে এগুলো ঢেকে রাখা হয়েছে। তবে নিয়মিত খাবার দাবার প্রদান করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সংরক্ষণ কেন্দ্রর ভেতর দিয়ে যে সড়ক গেছে তা দিয়ে আশপাশের কয়েকটি এলাকার মানুষ যাতায়াত করেন। ফলে চাইলেও আমরা মানুষজনের প্রবেশ পুরো বন্ধ করে রাখতি পারি না। অনেক সময় দেখা যায় যাওয়া আসার সময় মানুষজন খাঁচার ভেতরের প্রাণীদের বিরক্ত করেন। খোঁচাখুচি করেন। একারণে অনেক প্রাণী মারাও গেছেন। দিনের বেলা আমরা পাহারা দিতে পারি। কিন্তু রাতে পাহারা সম্ভব হয় না। তাই আমরা প্রাণীগুলো ঢেকে রেখেছি।
তিনি বলেন, এখন করোনার কারণে যেহেতু দর্শনার্থী প্রবেশ বন্ধ তাই প্রাণীগুলো ঢেকে রেখেছি। করোনা শেষ হলে আবার উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।
তবে এভাবে ঢেকে রাখার কারণে প্রাণীদের বিকাশ বাধাগ্রস্থ হবে জানিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, প্রাণীদের পূর্ণ বিকাশের জন্য প্রচুর আলো বাতাস প্রয়োজন হয়। কেবল খাবার খেয়ে কেউ বেঁচে থাকতে পারে না। পাখি যদি আকাশই দেখতে না পেরে তবে সে বিকশিত হবে কি করে। রএছাড়া এভাবে খাঁচা ঢেকে রাখার ফলে অক্সিজেনেরও ঘাটতি দেখা যেতে পারে। ফলে অনেক প্রাণী মারাও যেতে পারে।
কিম বলেন, ইতোমধ্যে অনেক প্রাণী এভাবে মারাও গেছে হয়তো। কিন্তু যেহেতু করোনাকাল, কেউ যেতে পারছে না। আমরা দেখতে পারছি না। তাই মৃত্যুর খবর পাচ্ছি না।
ত্রিপলী দিয়ে প্রাণীদের এভাবে ঢেকে রাখা ঠিক হয়নি জানিয়ে সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) এস এম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, এই বিষয়টি আমার জানা ছিলো না। এভাবে ঢেকে রাখার কথা না। এখনই আমি খোঁজ নিয়ে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিচ্ছি।
তিনি বলেন, শুরুর দিকে অচেনা পরিবেশ, শব্দ ও বায়ু দূষণের কারণে অনেক প্রাণী মারা গিয়েছিলো। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এখানে কোনো প্রাণী মারা যায়নি।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষন কেন্দ্রে দায়িত্বরত সূত্রে জানা যায়, উদ্বোধনের পর শুরুর একবছরে এখানকার ৩টি ময়ুর, ১টি অজগর সাপ, ৭টি লাভবার্ড, ২টি বাজিগর পাখি, চুকার পেকটিস পাখি ১টি, ২টি কালিম পাখি, থাইল্যান্ডের কৈকাপ মাছ ২টি, খরগোশ ২টিসহ অন্তত ২৬টি প্রাণী মারা যায়।
সংপ্লিস্টরা জানান, শব্দ ও বায়ু দূষণ ছাড়াও ছোট খাঁচায় আবদ্ধ থাকা এবং এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় এসে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরেও মারা যাচ্ছে এখানকার প্রাণী। এসব সমস্যার কারণে এই কেন্দ্রে প্রাণীদের প্রজননও হচ্ছে না।

সংবাদটি শেয়ার করুন