• ২৬শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ২৪শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

৪০০ কোটি টাকা ব্যয়, তবু জলাবদ্ধতা মুক্ত হচ্ছে না সিলেট

Daily Jugabheri
প্রকাশিত আগস্ট ২৯, ২০২১
৪০০ কোটি টাকা ব্যয়, তবু জলাবদ্ধতা মুক্ত হচ্ছে না সিলেট

যুগভেরী রিপোর্ট :::
দুই পাশে টিলা ভূমি। মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে সুরমা নদী। টিলা ভূমি থেকে নেমে অনেকগুলো খাল এসে মিলেছে নদীতে। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট বলে প্রশস্ত এই খালগুলোকে ছড়া বলা হয়। এসব ছড়া দিয়ে বর্ষায় পানি এসে মিশে যায় নদীতে। ফলে অনেক বৃষ্টি হলেও শহরে জলাবদ্ধতা হয় না।
এই ছিলো সিলেট শহর। প্রাকৃতিকভাবেই এমন সুবিন্যস্তভাবে গড়ে উঠেছিলো এই শহর। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ন, ছড়া-খাল দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ আর জলাশয় ভরাটের কারণে গত দুই দশকে বদলে গেছে সিলেটের চিত্র। এখন ভারি বৃষ্টি হলেই জলমগ্ন হয়ে পড়ে নগর। সড়ক ছাপিয়ে বাড়িঘর-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও ঢুকে যায় পানি। ফলে দুর্ভোগ পোহাতে হয় নগরবাসীকে।
দখল ও ভরাট হয়ে যাওয়া ছড়া খাল উদ্ধার করে সিলেট নগরকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে গত এক দশকে অন্তত ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সিলেট সিটি করপোরেশন। কিন্তু এতেও জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে নিস্তার মিলছে না। এবার বর্ষায় অন্যান্য বছরের চাইতে বৃষ্টি হয়েছে তুলনামুলক কম। তবু অন্তত ৩/৪ দিন বৃষ্টির জলে ডুবেছে নগর। সর্বশেষ গত ১৪ জুলাই রাতে ঘন্টা দুয়েকের বৃষ্টিতে জলমগ্ন হয়ে পড়ে নগরের বেশিরভাগ এলাকা। অনেক সড়কে হাঁটুপানি জমে যায়। পানি ঢুকে পড়ে বাসাবাড়িতে।
এতো টাকা খরচের পরও ছড়া উদ্ধার না হওয়া ও নগর জলাবদ্ধতা মুক্ত না হওয়ায় এসব প্রকল্পের যথাযথ বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, সিলেট নগরীর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ছোট বড় প্রায় ২৫ টি ছড়া। তবে দখল-দুষণে এখন অনেক স্থানে ছড়ার অস্তিত্বই হারিয়ে গেছে। নগরের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া ১৩টি বড় ছড়ার দৈর্ঘ্য প্রায় ৭৩ কিলোমিটার। দীর্ঘদিন ধরেই এসব ছড়ার দু’পাশ দখল করে রেখেছে স্থাপনা নির্মাণ করেছে অবৈধ দখলদাররা। এই ছড়াগুলো উদ্ধারে এ পর্যন্ত তিনটি প্রকল্পে এ পর্যন্ত প্রায় ৪০০ কাটি টাকা ব্যয় করেছে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। সর্বশেষ ২০১৬ সালে ছড়া-খাল দখলমুক্ত করতে ২৩৬.৪০ কোটি টাকার বৃহৎ একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। তবে এসব বৃহৎ প্রকল্পের পরও ছড়া দখলমুক্ত করা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ছড়া-খাল দখলদারদের একটি তালিকা করা হয় ২০১৬ সালে। এতে ২৬৮ জনকে দখলদার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দখলদারদের বেশিরভাগই প্রভাবশালী। এছাড়া কয়েকটি সরকারী প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। ছড়া-খাল দখল করে এরা গড়ে তুলেছেন বহুতল ভবন। অনেকে পরিবর্তন করে ফেলেছেন ছড়ার গতি। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে পানি নিষ্কাষণের পথ। এতে বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
সিলেট নগরীর অন্যতম এই সমস্যা সমাধানে ২০০৯ সালে নগরীর ছড়াগুলো উদ্ধারে ১১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করে সিলেট সিটি করপোরেশন। এরপর ২০১৩ সালে একই লক্ষ্যে গ্রহণ করা হয় ২০ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প। এরপর নগরীর ছড়া খাল উদ্ধারে ২০১৬ সালে নেওয়া হয় ২৩৬ কোটি ৪০ লাখ টাকার মেঘা প্রকল্প। এছাড়া এই সময়ে নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে আরও কয়েকটি ছোট ছোট প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। তবে এতো প্রকল্প, এতো অর্থ ব্যয় সত্ত্বেও প্রভাবশালী দখলদারদের উচ্ছেদ করতে না পারায় এসব প্রকল্পে তেমন সাফল্য আসেনি। মুক্তি মেলেনি জলাবদ্ধতা থেকে।
এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ছড়া খাল উদ্ধারে একাধিক প্রকল্প নেওয়া হলেও নগরবাসী তার খুব একটা সুফল পায়নি। প্রকল্পের বাস্তাবায়ন নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এসব প্রকল্পের ব্যাপারে সিটি করপোরেশনও তার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করেনি। ফলে জলাবদ্ধতা নিরসন হচ্ছে না। প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিশ্চিতের পাশপাশি দীর্ঘমেয়াদী সুফল পেতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শও নেওয়া প্রয়োজন।
তবে এমন দাবির সাথে দ্বিমত পোষণ করে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান বলেন, আমরা প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার ছড়া উদ্ধার করেছি। এতে নগরীতে আগেরমতো আর জলাবদ্ধতা হয় না। অধিক বৃষ্টিতে নগরীতে নগরীর কিছু এলাকায় পানি জমলেও অল্প সময়ের মধ্যে তা নেমে যায়।
তিনি বলেন, অনেকক্ষেত্রে আমরা দখলদারদের উচ্ছেদ করার পর ফের ছড়া দখল হয়ে যায়। এছাড়া ময়লা-আবর্জনা ফেলেও ছড়ার পানি নিষ্কাষণে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয়। এজন্য সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। এটা কোনোভাবেই সিটি কর্পোরেশনের একার পক্ষে সম্ভব নয়।
আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল ছড়া উদ্ধার করে জলাবদ্ধতা থেকে নিস্তার মিলবে না। কারণ নগরের ভেতর দিয়ে প্রবাহমান সুরমা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুমে তাই নদী পানিতে টুইটুম্বুর হয়ে যায়। ফলে ছড়ার পানি টানতে পারে না নদী। একারণে নদীর তলদেশ খননের প্রয়োজন বলেও মনে করেন তারা। এসব ছড়া-খালে ময়লা আবর্জনা ফেলা বন্ধ করতে হবে বলেও মত বিশেষজ্ঞদের।
সিলেট নগরের উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের সাথে যুক্ত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও পুর প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম বলেন, সুরমা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। এর কারণে নগরের পানি নিষ্কাষণ হতে পারে না। নগরকে জলাবদ্ধকা মুক্ত করতে হলে সুরমা নদী খনন করতে হবে। না হলে কেবল ছড়া উদ্ধার করে কোনো সুফল মিলবে না।
তবে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর দাবি, সিলেটে আর আগের মতো জলাবদ্ধতা হয় না। ভারি বৃষ্টিতে কিছু এলাকায় পানি জমলেও পরক্ষণেই তা নেমে যায়। ছড়াগুলো আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব না হলেও অনেকাংশে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে এবং উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সুরমা নদীর তলদেশ ভরাট হওয়ায় পানি নামতে পারে না। এছাড়া কিছু এলাকা ওয়াটার লেভেল থেকেও নিচু। নিচু এলাকার জলাবদ্ধতার সমস্যা এ বছর নিরসন হচ্ছে না। কারণ নিচু এলাকায় পাম্প স্থাপন করে জমে থাকা বৃষ্টির পানি খালে ফেলতে হবে। এবার আমরা পাম্প বসানোর কাজ করতে পারছি না। আশা করি শুষ্ক মৌসুমে এ কাজ করতে পারব।

সংবাদটি শেয়ার করুন