নিজস্ব সংবাদদাতা, হবিগঞ্জ
হবিগঞ্জে বেড়েছে অপমৃত্যুর ঘটনা। পারিবারিক কলহসহ ব্যক্তিগত নানা সমস্যার কারণে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন অনেকে। চলতি বছরের ৯ মাসে হবিগঞ্জে ‘আত্মহত্যা’ করেছেন ১২২ জন। এর মধ্যে বিষপানে ৫৬ এবং গলায় ফাঁস নিয়ে ৬৬ জন। আত্মহত্যার প্রবণতা নারীদের মধ্যে বেশি থাকলেও বর্তমানে পুরুষদের মধ্যে বেড়েছে। এরমধ্যে বেশির ভাগই তরুণ বলে জানায় পুলিশের একাধিক সূত্র।
পুলিশের তদন্তে আত্মহত্যার অনেক কারণ বেরিয়ে এসেছে। এরমধ্যে পারিবারিক, ঋণগ্রস্ত, অসুস্থতা, প্রেম, অতিরিক্ত অভিমান, বিবাহ বিচ্ছেদ ও পরকীয়াসহ বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে।
তবে সমাজবিজ্ঞানী ও মনরোগ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পারিবারিক সহযোগীতার পাশাপাশি সামাজিক সহযোগীতা পেলে মানুষের আত্মহনন কমে আসবে।
জেলা পুলিশের ডিএসবি শাখা থেকে জানা যায়, ২০১৮ সালে অপমৃত্যু হয়েছে ১১১টি। এর মধ্যে ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয় ৩৪ জনের ও বিষপানে মৃত্যু হয় ৪৭ জনের। ২০১৯ সালে ১৩২টি, এর মধ্যে ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার হয় ৭৪ জনের ও বিষপানে ৫৮ জন। ২০২০ সালে ১৩৬টি, এরমধ্যে ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার হয় ৯০ জনের ও বিষপানে ৪৬ মৃত্যু হয়।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জেলায় অপমৃত্যু হয়েছে ১২২ জনের। এরমধ্যে বিষপানে ৫৬ এবং ঝুলন্ত অবস্থায় ৬৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। জানুয়ারিতে জেলায় ৯ জনের অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও মে এবং জুনে মাসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে দ্বিগুণে। মে মাসে ১৭ জন এবং জুনে ১৮ জন আত্মহননের পথ বেছে নেন।
জেলায় আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি বানিয়াচং উপজেলায়। এখানে গত ৮ মাসে আত্মহত্যা করেছেন ৩১ জন। আর সবচেয়ে কম লাখাইয়ে। এখানে ৮ মাসে আত্মাহুতি দিয়েছেন মাত্র একজন।
এ ছাড়া চলতি বছর হবিগঞ্জ সদরে ১৩, বানিয়াচং ৩১, আজমিরীগঞ্জ ৭, নবীগঞ্জ ১৭, বাহুবল ৯, চুনারুঘাট ১৯, লাখাই ১, মাধবপুর ১৭ এবং শায়েস্তাগঞ্জ পাঁচজন ‘আত্মহত্যা’ করেছেন।
বেশ কিছু ঘটনার তদন্তের পর ‘আত্মহত্যার’ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছে পুলিশ। পারিবারিক বিভিন্ন কলহ, মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যয় এবং প্রেমসংক্রান্ত বিষয়কে এর কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে। তবে পারিবারিক কলহের জেরে নারীরা এবং মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার কারণে পুরুষেরা এ পথ বেছে নিচ্ছে। আর তরুণদের একটি বিরাট অংশের ‘আত্মহত্যা’র কারণ হিসেবে পাওয়া গেছে প্রেমঘটিত ঘটনা। এর মধ্যে প্রেমে বিচ্ছেদ এবং প্রিয় মানুষের সঙ্গে বিয়ে না হওয়া।
পুলিশ বলছে, জেলায় বেশ কয়েকজন তরুণের আত্মহত্যার ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে কোনো কারণই চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। তবে তাদের মধ্যে পাইলসের সমস্যা পাওয়া গেছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, পাইলসের সমস্যায় ভোগার কারণে লোকলজ্জার ভয়ে কাউকে কিছু না বলতে পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।
এ বিষয়ে নবীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ ডালিম আহমেদ বলেন, ‘আত্মহত্যার প্রবণতা আগের চেয়ে বেড়েছে। আমি সম্প্রতি যতগুলো আত্মহত্যার তদন্ত করেছি, তার মধ্যে বেশি পেয়েছি পারিবারিক কলহ এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হওয়া। এ ছাড়া তরুণ-তরুণী বা কিশোর-কিশোরীর আত্মহত্যার বেশি কারণ প্রেম সংক্রান্ত বিষয়।’
জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। এসব আত্মহত্যার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ নির্দিষ্ট কিছু কারণ পেয়েছে। এর মধ্যে পারিবারিক বিভিন্ন কলহ, মানসিক বিপর্যয় এবং প্রেমসংক্রান্ত বিষয় বেশি। এ ছাড়া একটি কারণ আমাদের অবাক করেছে। আত্মহত্যার কারণ তদন্তের পর ধারণা করা হচ্ছে; পাইলসের সমস্যায় ভোগার কারণে লোকলজ্জার ভয়ে কাউকে কিছু না বলতে পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের জরিপে উঠে এসেছে দেশের অর্ধেক মানুষ এখন বিষন্ন। গত দুই বছরে বিষন্নতা বেড়েছে আড়াই গুণ। বর্তমানে ৪৬ শতাংশ মানুষ বিষন্নতায় ভুগছে, যা ২০১৮ সালে ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ।
পার্কভিউ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. দীপেন্দ্র নারায়ন দাস মনে করেন, মানুষ বিভিন্ন কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকে, যখন কোন কিছু পাওয়ার ইচ্ছা হয় আর সেটি না পাওয়া যায় তখন তার নিজের প্রতি রাগ করে বেচেঁ থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আমাদের অনেকেই কাছেও এমন রোগী নিয়ে আসেন। আমরা পরিবারের লোকজনদের বুঝিয়ে দেই তাকে যেন মানসিকভাবে সাহস যোগিয়ে রাখেন। পরিবারই পারে আত্মহত্যার পথ বেচে নেয়া লোককে মৃত্যুও দোয়ার থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. তানজিনা চৌধুরী বলেন, আত্মহত্যার পথ বেচে নেওয়া মানুষের পরিবারের কাছ থেকে সাপোর্ট দরকার। যেমন ২০১২-১৩ সালে গ্রেজুয়েট শেষ হয়ে গেছে অথচ কোন কিছুই করতে পারছেন না তারা হাতাশ হয়ে গেছে। তখন পরিবারেরই বেশি সাপোর্ট দরকার, এখানে রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব আছে। পরিবার তো কাছে থেকে সব দেখেন। রাষ্ট্রতো আর দেখতে পারছেন না তারা কি মানসিকতার অসুবিধা, বা যন্ত্রনা হচ্ছে।
তিনি বলেন, যদি দেখি মানুষ আত্মহত্যা করছে কখন? এটা কিন্তু অনেক সাহসি একটা সিদ্ধান্ত আমি চাইলেই আজ আত্মহত্যা করতে পারবো না। একটা মানুষ তাকে পুরো শেষ করে দিচ্ছে এটা অনেক বড় সাহসের ব্যাপরা। আমরা সমাজের মানুষই তাকে ওই জায়গায় ঠেলে দিচ্ছি, যে তার আর ভালো লাগছে না আমাদের কাউকেই। সেই জায়গা থেকে পরিবার সাহাস্য করতে পারবে। যতটুকু সম্ভব মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ব্যক্তিদের তুমাকে দিয়ে হচ্ছে না বা হবে না, তুমি এই ভুল ওই ভুল করছো এসব না বলাই ভালো হয়।