• ২৩শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১০ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ১৪ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

একজন নিঃস্ব ফজর আলী, খাবার দিতে না পারায় তিন সন্তানকে দিয়েছেন অন্যের বাড়ি

Daily Jugabheri
প্রকাশিত জানুয়ারি ৩০, ২০২২
একজন নিঃস্ব ফজর আলী, খাবার দিতে না পারায় তিন সন্তানকে দিয়েছেন অন্যের বাড়ি

বিন্দু তালুকদার, সুনামগঞ্জ
দূর থেকে দেখলে যে কারো মনে হবে ত্রিপালে ঢাকা কোন বস্তু। কিন্তু না, আসলে এর ভেতরে একটি পরিবারের থাকার জায়গা। এটি সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষীপুর ইউনিয়নের সুলতানপুর গ্রামের দরিদ্র ফজর আলীর মাথা গোঁজার শেষ ভরসা।
ফজর আলীর নিজের বসতবাড়ি ছিল, ছিল সুখের সংসার। কিন্তু স্ত্রীর মরণব্যাধি ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যয় তাকে নিঃস্ব করেছে। অভাবের কারণে চার মেয়ের মধ্যে এক মেয়েকে দত্তক ও দুই মেয়েকে অন্যের কাছে পালক দিতে হয়েছে তাকে। ভিটেমাটি ও ঘরবাড়ি হারিয়ে সন্তানদের দূরে দিয়ে ফজর আলী থাকছেন পতিত বাড়িতে একটি তাবুর নিচে।
ফজর আলী অতি দরিদ্র হলেও সরকারি কোন ভাতা পান না। অবশ্যই স্থানীয় ইউপি সদস্য বলেছেন, ফজর আলীকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। বিষয়টি জানার পর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাও বলেছেন, ফজর আলীকে সরকারি ঘর ও তার স্ত্রীর চিকিৎসা সহায়তা প্রদানে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষীপুর ইউনিয়নের সুলতানপুর গ্রামের কৃষক পরিবারের সদস্য ফজর আলী (৪০)। তাঁরা তিন ভাই। তিনি সবার ছোট। বড় দুই ভাই শুকুর আলী ও কালা শাহ কৃষক ও শ্রমজীবী। গ্রামে ফজর আলীর সাড়ে ৭ শতক বসত-ভিটা ছিল। প্রায় ১৫ বছর আগে সিলেটের বিশ^নাথে বিয়ে করেন তিনি। স্ত্রী রাসনা বেগম, মেয়ে ফাতেমা বেগম (৮), হালিমা বেগম (৬), নাজিয়া আক্তার (৪) ও সানজিদা আক্তার (আড়াই বছর) কে নিয়ে সংসার ভালই কাটছিল। তিনি কিছুদিন সিলেটের বিয়ানীবাজারে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। কিন্তু হটাৎ করে প্রায় দুই বছর আগে তার স্ত্রী রাসনা বেগম (৩৬) দূরারোগ্য ব্যাধি (জরায়ু ও লিভার ক্যান্সার) আক্রান্ত হওয়ায় সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। ক্যান্সার আক্রান্ত স্ত্রী রাসনা বেগমের চিকিৎসা করাতে সহায় সম্বল সবকিছু বিক্রি করার সাথে মাথা গোঁজার বসতভিটাও মাত্র ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন। অর্থাভাবে স্ত্রীর চিকিৎসা করতে না পেরে কয়েকদিন আগে সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে চলে আসেন গ্রামে। কিন্তু নিজের বসতভিটা, ঘর-বাড়ি না থাকায় রোগাক্রান্ত স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে বেঁেচ থাকার কঠিন জীবন যুদ্ধের সন্মুখিন হন ফজর আলী।
নিজের ঘর ও বসতভিটা হারিয়ে ভূমিহীন ফজর আলী কয়েক দিন ছিলেন খোলা আকাশের নিচে। এমনকি তাদের ছিল না থাবা-বাটি, রান্নার কোন হাড়ি-পাতিল ও বিছানাপত্র। সুলতানপুর গ্রামের বাসিন্দা সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী ফখর উদ্দিন ও পাশর্^বতী তিলুরা গ্রামের আরেক সমাজসেবক মো. নূর মোহাম্মদ বিষয়টি নিজেদের ফেসবুকে প্রচার করলে ফজর আলীর অবস্থার জানাজানি হয়। সুলতানপুর গ্রামবাসী বাঁশের খুটি দিয়ে ছোট্ট একটি ত্রিপাল টানিয়ে পতিত বাড়িতে ফজর আলী ও তার স্ত্রী-সন্তানদের সাময়িকভাবে থাকার জন্য একটি তাবু তৈরি করে দেন। গ্রামবাসীর সহায়তায় কোন রকমে থাকার ব্যবস্থা হলেও সন্তানদের মুখে খাবার দিতে না পারায় চার সন্তানের মধ্যে বড় দুই সন্তানকে পালক ও এক সন্তানকে দিয়েছেন দত্তক। সার্বক্ষণিক শয্যাশায়ী স্ত্রী রাসনা বেগম ও ৩ বছর বয়সী ছোট্ট মেয়ের দেখাশুনা করতে কোন কাজও করতে পারছেন না তিনি। স্থানীয়দের অনুগ্রহে দেওয়া খাবার খেয়ে কোনভাবে দিন কাটাচ্ছেন ফজর আলী ও তার স্ত্রী-মেয়ে।
সুলতানপুর গ্রামের বাসিন্দা হাজী হুমায়ুন মিয়া ও হাজী নিজাম উদ্দিন বললেন,‘ ফজর আলী বউ-বাচ্ছা নিয়ে খুব বিপদে পড়েছে। তার বউয়ের ক্যান্সার চিকিৎসা করতে গিয়ে বাড়িটা পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছে। এখন তার থাকার মত কোন জায়গা নাই, ছোট ছোট মেয়েদের খাওয়ানোর কোন সামর্থ নেই তার। তিন বাচ্ছাকে পালক দিয়েছে। গ্রামের মানুষ বাঁশ ও ত্রিপাল দিয়া তাকে একটা উড়া (তাবু) তৈরি করে দিয়েছেন। কিছু জিনিসপত্র কিনে দিয়েছেন। ফেসবুকে ফজর আলীর এই অবস্থা দেখে মানুষ আর্থিক সাহায্য করছেন।’
ফজর আলীর স্ত্রী রাসনা বেগমের আকুতি তিনি বাঁচতে চান সন্তানদের সাথে। সবার প্রতি অনুরোধ জানিয়ে রাসনা বেগম বলেন,‘ আমার কোমড়ে ব্যাথা, পেটে ব্যাথা। সারা শরীরেই ব্যাথা করে। সোজা হয়ে বসতে ও উঠতে পারি না। নিজের কোন ঘরবাড়ি ও থাকার জায়গা নেই। খাবার দিতে পারি না তাই চারটি মেয়ের মধ্যে একটি মেয়েকে দত্তক ও দুইটি মেয়েকে দেখাশুনার করার জন্য অন্যের বাড়িতে দিয়েছি। আমি চিকিৎসা করতে চাই, মেয়েগুলোর জন্য বাঁচতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটু সাহায্য চাই।’
দরিদ্র ফজর আলী বলেন,‘ আমি গরিব মানুষ। ডাক্তার কইছঅইন আমার স্ত্রীর ক্যান্সার অইয়া গেছে। অনেক কষ্ট কইরা কয়েকদিন একটি বেসরকারি হাসপাতালে পরে ওসমানী মেডিকেলে ডাক্তার দেখাইছি। পরে সিট কাইট্টা বিদায় কইরা দিছে। টেকা-পয়সাও নাই তাই গাঁও লইয়া আইছ। গাঁওয়ে থাকবার জাগা নাই। গাঁওয়ের মানুষ একটা বাঁশ-তিপাল দিয়া উড়া বাইনা দিছঅইন। আমি সবার কাছে সাহায্য চাই। চারটা মেয়েরে খানি দিতাম পারি না, তাই ছুড পুরিডারে দত্তক ও বড় দুইডারে পালবার লাগি আত্মীয় বাড়িত দিয়া দিছি।’
লক্ষীপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নং ওয়ার্ডের স্থানীয় ইউপি সদস্য ফারুক মিয়া বললেন, ‘ আমি নতুন মেম্বার নির্বাচিত হয়েছি। ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে ফজর আলীকে সব ধরনের সহায়তা প্রদান করব আমরা। তাকে একটি সরকারি ঘর দেওয়ার জন্য চেয়ারম্যান সাবও ইউএনও স্যারের সাথে কথা বলেছেন। ফজর আলীর সার্বিক আমরা ইউএনও স্যারকে অবগতি করেছি।’
এই প্রতিবেদকের মাধ্যমে অসুস্থ রাসনা বেগমের চিকিৎসার সকল কাগজপত্র দেখেছেন সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাক-কান ও গলা রোগ বিশেষজ্ঞ ও আবাসিক সার্জন ডা. এম নুরুল ইসলাম। তিনি বললেন,‘ রাসনা বেগম প্রথমে জরায়ূ ক্যান্সারে ভোগছিলেন। পরে লিভার ক্যান্সারসহ নানা রোগে ভোগছেন। দ্রুত তার উন্নত চিকিৎসা করা প্রয়োজন।’
দোয়ারাবাজার উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলাম বলেন,‘ স্থানীয় ইউপি সদস্যের ফেসবুকের মাধ্যমে ফজর আলীর স্ত্রী রাসনা বেগমের অসুস্থতার বিষয়টি জেনেছি। তার চিকিৎসার জন্য সরকারি অর্থ সহায়তা প্রদানে আমি সর্বাত্মক সহযোগিতা করব। এছাড়াও ফজর আলীর অসুস্থ স্ত্রী রাসনা বেগমের চিকিৎসা করতে সরকারি কোন হাসপাতালে ভর্তি হলে আমরা হাসপাতাল সমাজসেবার মাধ্যমে যতুটুকু সম্ভব সহযোগিতা করব।’
দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেবাংশু কুমার সিংহ বললেন,‘ফজর আলী যেহেতু ভূমিহীন, তাকে সরকারি ভূমিসহ মুজিব বর্ষের সরকারি একটি ঘর দেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য অর্থ সহায়তা প্রদানেও সমাজসেবার মাধ্যমে চেষ্টা করব আমরা।’

সংবাদটি শেয়ার করুন