• ২রা নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১৭ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ৩০শে রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

ইচ্ছেখুশি পাঠদান করেন যেসব প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকেরা!

Daily Jugabheri
প্রকাশিত মার্চ ১৩, ২০২২
ইচ্ছেখুশি পাঠদান করেন যেসব প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকেরা!

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি
বিকাল প্রায় ৩ টা। নিয়ম অনুযায়ী এই সময়ে প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান চলার কথা। কিন্তু ৭ মার্চ সোমবার সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার বেহেলী ইউনিয়নের হিজলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি দেখতে পাওয়া যায় তালাবদ্ধ। ঘড়ির কাটা ৩ টার দিকে এগুতেই শিক্ষকরা বিদ্যালয় ছুটি দিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছেন।
হিজলা গ্রামের লোকজন জানান, তাদের বিদ্যালয়ে এভাবেই নিয়মিত পাঠদান চলে। শিক্ষকরা প্রতিদিনই বেলা ১০ টা থেকে সাড়ে ১০ টায় বিদ্যালয়ে পৌঁছেন। আবার বিকাল ৩ টার পূর্বেই বিদ্যালয় ছুটি দিয়ে উপজেলা সদরে চলে যান। একদিন, দু’দিন নয়, বছর বছর ধরে শিক্ষকরা এভাবেই পাঠদান দেওয়ার বিষয়টি জানালেন বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মৃত্যুঞ্জয় বর্মণ।
গ্রামবাসী জানান, হিজলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ৪ জন, ছাত্র-ছাত্রী মাত্র ২৯ জন। অথচ এই বিদ্যালয়ের কোন শিক্ষার্থী বৃত্তি ও জিপিএ-৫ পায় না গত ৮/১০ বছর ধরে। শিক্ষকদের কারণে শিক্ষার মান উন্নয়ন হচ্ছে না দাবি গ্রামের লোকজনের।
হিজলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলাল উদ্দিন বলেন,‘ আমি ৬ দিনের প্রশিক্ষণে উপজেলা সদরে ছিলাম। ৩ টার আগে স্কুল ছুটি দেওয়ার কথা না। আমরা চেষ্টা করছি শিক্ষার মান উন্নয়নে। গত কয়েক বছরে বৃত্তি ও জিপিএ-৫ পায় না এটা সঠিক। তবে আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে।’
শুধু হিজলাই নয়, পাশের মাহমুদপুর, দুর্গাপুর ও মদনাকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় একই অবস্থা বলে জানালেন বেহেলী ইউনিয়ন পরিষদের ২ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য দেবাশীষ চন্দ্র তালুকদার। বিষয়টি লিখিতভাবে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবগত করবেন বলে জানান তিনি। তিনি বললেন,‘ শিক্ষকরা ১০ টার মধ্যে কোনদিনই স্কুলে আসতে পারেন না। উনারা (শিক্ষকরা) তিন টার আগেই চলে যান। তিনটার পরে কোন স্কুলেই থাকেন না উনারা। বার বার লেখালেখির কারণে এখন মদনাকান্দি স্কুলের একটু পরিবর্তন হয়েছে। ’
শিক্ষকদের কারণে এলাকার চারটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নয়ন হচ্ছে না বলে মন্তব্য করলেন এই ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য মো. মশিউর রহমানও।
দুর্গাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুজিত কুমার চক্রবর্তী বললেন,‘ সোমবার দুপুরে বিদ্যালয়ের কাজে আমি উপজেলা সদরে গিয়েছিলাম। আমি বয়স্ক মানুষ, আমার স্কুলের ৩০ জন ছাত্র-ছাত্রী। কিন্তু শিক্ষক আমি একা। কোন কারণে উপজেলা সদরে গেলে অনিচ্ছনা সত্ত্বেও স্কুল বন্ধ রাখতে হয়। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করি স্কুলে নিয়মিত যেতে ও পাঠদান করতে।’
মাহমুদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জুঁই তালুকদার বললেন,‘ ৭ মার্চ আমরা পৌণে ৪ টা পর্যন্ত বিদ্যালয়ে ছিলাম। প্রতিদিন দেরি করে যাই, এটা মোটেও ঠিক না। মাঝেমধ্যে হয়তো দেরি হয়। বর্তমান মেম্বার কোনোদিন স্কুলেই আসেন নি। সাবেক মেম্বার বাড়িতেই থাকেন না। আমাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সঠিক না। ’
মদনাকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মানিক চন্দ্র পাল বলেন,‘ স্কুলে নৌকা দিয়ে যেতে হয়। মাঝে মধ্যে মোটরসাইকেলে যাই, যার কারণে কিছুটা বিলম্ব হয়। ২০১৯ সালে আমাদের দুই জন ছাত্র বৃত্তি পেয়েছিল। চারজন শিক্ষকের মধ্যে বর্তমানে দুই জন দায়িত্ব পালন করছি। আমি যতটুকু সময় স্কুলে থাকি সবটুকু সময় গুরুত্বসহকারে পাঠদান করি।’
বিকাল ৩ টায় বিদ্যালয় ছুটি দেওয়ার বিষয়ে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শরিফ উদ্দিনের সাথে কথা বলতে চাইলে ফোন রিসিভ করেন নি। খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন বলে জানালেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ^জিৎ দেব ও বেহেলী ক্লাস্টারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারি শিক্ষা কর্মকর্তা গোলাম রাব্বী জাহান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাওর এলাকায় অনেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদানের এমন অবস্থা। যার ফলে প্রাথমিক শিক্ষার মান দিনদিন নি¤œমূখি হচ্ছে। স্থানীয়দের দাবি যতটুকু সময় পাঠাদান দেন শিক্ষকরা সেই সময়টুকু ভাল করে পাঠদান দিলে শিক্ষার মান আরও বৃদ্ধি হত ।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্য অনুযায়ী জেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১৪৭৫ টি। কর্মকর্তা, কর্মচারি ও অনেক শিক্ষক সংকট রয়েছে। ৮৫৩ টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ৬৪৮ জন, পদশূন্য রয়েছে ২০৫ টি। এরমধ্যে ৪৪ টি কর্মকর্তার পদ শূণ্য। প্রধান শিক্ষকের ২৬১ টি ও ৬৩৬ টি সহকারি শিক্ষকের পদ শূণ্য আছে। উচ্চমান সহকারি কাম হিসাবরক্ষক ও অফিস সহকারি কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক ২৬ টি পদ শূণ্য রয়েছে। ১২ জন অফিস সহায়ক একজনও নেই।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম আব্দুর রহমানের দাবি, অভিযোগ অনুযায়ী ততটা নি¤œমূখি নয় সুনামগঞ্জের প্রাথমিক শিক্ষার মান। তিনি বললেন,‘ সুনামগঞ্জের প্রাথমিক শিক্ষায় কর্মকর্তা, শিক্ষক ও কর্মচারি সংকট রয়েছে। জনবল সংকট নিরসনে কর্তৃপক্ষকে বার বার অনুরোধ জানানো হচ্ছে। নতুন শিক্ষক নিয়োগ হলে সংকট নিরসন হবে এবং শিক্ষার মানোন্নয়ন হবে।’
মধ্যনগর উপজেলার মজলিসপুর গ্রামের বাসিন্দা সুনামগঞ্জ পৌর ডিগ্রি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন,‘ শিক্ষার মান নি¤œমুখি হওয়ার মূল কারণ সরকারি ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষকদের পাঠদানে অমনযোগি। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সচেতনার অভাবও রয়েছে। যদিও শিক্ষকদেরও নানা অভিযোগ ও দাবি-দাওয়া রয়েছে। সুষ্ঠু ব্যবস্থপনায় শিক্ষকরা পাঠদানে মনযোগি হলে অবশ্যই শিক্ষার মানোউন্নয়ন হবে। ’

সংবাদটি শেয়ার করুন