• ২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ১৮ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

হস্তশিল্পের চলছে দুর্দিন, হারিয়ে যেতে বসেছে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটি

Daily Jugabheri
প্রকাশিত মার্চ ১৩, ২০২২
হস্তশিল্পের চলছে দুর্দিন, হারিয়ে যেতে বসেছে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটি

চৌধুরী ভাস্কর হোম, মৌলভীবাজার
বৃহত্তর সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটি হস্তশিল্পের এখন দুর্র্দিন যাচ্ছে। শীতলপাটির একমাত্র উপকরন মুর্তা বেতের চাষ প্রায় বিলিন হয়ে গেছে। অথচ সিলেট বিভাগে বিয়ের অনুষ্ঠান হতোনা শীতলপাটি ব্যতিত। সৌখিনতার প্রতীক ছাড়াও নকশী কারুখচিত শীতলপাটি উন্নত রুচি ও আভিজাত্যের একটি পন্য। বেতের সংকট এবং পর্যাপ্ত পৃষ্টপোষকতার অভাবে এ শিল্প হুমকীর মুখে পড়েছে। এই শিল্পের সাথে জড়িতদের প্রায়ই ভীষণ অর্থনৈতিক সংকট আর টানাপোড়েনের মধ্যে চলছে জীবন। তবুও জীবিকার তাড়নায় কোনোমতে আঁকড়ে আছেন বাপ-দাদার পুরনো এই পেশা।
শীতলপাটির কদর সিলেট বিভাগ ছাড়াও দেশে বিদেশে রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। সরকারী পৃষ্টপোষকতার মাধ্যমে এশিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করে শীতলপাটি বিদেশেও রপ্তানী করা যেতে পারে। এতে সরকার পাবে বিপুল পরিমান বৈদেশীক মুদ্রা ও রাজস্ব। পাশাপাশি বেকারদের হবে কর্মসংস্থান। শীতলপাটির উপকরনের অপ্রতুলতায় অধিকমুল্যে মুর্তা ক্রয় করতে একটি শীতলপাটি বুনতে যে পরিমান খরচ হয়, সে অনুপাতে মুল্য পাওয়া যায়না বলে অভিযোগ শীতলপাটি শিল্পীদের।
সরেজমিনে মৌলভীবাজারের বড়লেখার তালিমপুর ইউনিয়নের হাকালুকি হাওর সংলগ্ন নিভৃত পল্লী পশ্চিম গগড়া গ্রামে বীরেশ দাসের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় ঘরের বারান্দায় বসে শীতল পাটি তৈরি করছেন বীরেশ দাস। তাঁর নিপুণ হাতে পাটিতে উঠছিল বাহারি রঙের নকশা। পাটিতে বাহারি নকশা তুললেও বীরেশ দাসের মনে নেই সেই রঙের ছিটেফোটাও। রাত-দিন পরিশ্রম করে আর্থিক স্বচ্ছলতা না আসায় মনে আনন্দ নেই। ভীষণ অর্থনৈতিক সংকট আর টানাপোড়েনের মধ্যে চলছে তাঁর সংসার। অন্য কিছু করার সুযোগ নেই। তাই জীবিকার তাড়নায় কোনোমতে আঁকড়ে আছেন বাপ-দাদার পুরনো পেশা।
বীরেশ দাস বলেন, প্রায় ২৫ বছর ধরে পাটি তৈরী করছি। কিন্তু এখন আর আগের মতো লাভ নেই, বেতও পাওয়া যায় না। বেতের দাম দিয়ে পাটি তৈরী করে সংসার চালানো যায় না। অন্য কোনো কাজ জানি না তাই এই কাজ করি। যারা কাজ পারেন, লেখাপড়া শিখেছেন তারা চাকরি করছেন। বিদেশে গেছেন। তাদের স্বচ্ছলতা এসেছে।
বেতের শীতল পাটি তৈরি কেবল বীরেশে দাসের পারিবারিক পেশাই নয়, বাংলার ঐতিহ্যবাহী ক্ষুদ্র ও খুটির শিল্পের অংশও এটা। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের এই শীতল পাটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো। তবে এ ঘোষণা সত্বেও ভাগ্য ফিরেনি শীতল পাটির শিল্পীদের। কাঁচামাল সঙ্কট ও নায্যমূল্য না পাওয়ায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন তাঁরা। যুগ যুগ ধরে পাটি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করলেও নায্য মূল্য না পাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে অনেকে এই পেশা ছেড়েছেন। তবে ঐতিহ্য হিসেবে বীরেশের মতো হাতেগোনা কিছু পরিবারে এখনো ঠিকে আছে পাটি শিল্প। টানাপোড়ন যাদের যাপিত জীবনের সঙ্গী।
গগড়া গ্রামের পাটিশিল্পী মানিক দাস বলেন, আগে ১৬ আনা মানুষই পাটি তৈরি করতো, এখন আছে দুই আনা। অন্য কাম পাইলে আমিও পাটি তৈরি করা ছেড়ে দিতাম। সরকারি সহযোগিতা পেলে কিছু স্বচ্ছলভাবে আমরা কাজ করতে পারতাম।
শীতলপাটির প্রধান উপকরন মুর্তাকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সিদ্ধ করে সুক্ষè ও মসৃন আঁশ বের করে শীতলপাটি বুনতে হয়। বুননের সময় বিভিন্ন ডিজাইন করার জন্য পছন্দমত রঙের মধ্যে বেতকে চুবিয়ে নেওয়া হয়। সুক্ষ্ম ও মসৃন ৭ফুট দৈঘ্য ও ৫ফুট প্রস্তের একটি শীতলপাটি বুনতে একজন দক্ষ কারিগরের সময় লাগে ৪ থেকে ৫ মাস। উন্নত ও সুক্ষ্ম শীতলপাটির মুল্য দেড় হাজার থেকে ২৫ হাজার হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয় বলে শীতলপাটির এক ব্যবসায়ী জানন। এসব শীতলপাটি যতœসহকারে ব্যবহার করলে ২৫/৩০ বছরেও নষ্ট হয়না। স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন মাপ ও নামের শীতলপাটি বুনা হয়। যেমন নয়নতারা, আসমানতারা, জোড়াকেচিরা, সিকি, আধুলি,টাকা ইত্যাদি। এসব নাম ছাড়াও বিভিন্ন আকৃতি ও বৈচিত্রে ভরপুর শীতলপাটি শহর ও গ্রামের বাজারে পাওয়া যায়। অতিতে মসজিদও বিয়ে বাড়িতে শীতলপাটি ব্যবহৃত হতো। কিন্তু যুগের বিবর্তনে এখন আর শীতলপাটি ব্যবহার না করে কার্পেট ও ডেকোরেটার্সএর আসবাবপত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে বাড়তি আরাম আয়েশের জন্য শীতলপাটি এখনও অভিজাত পরিবারগুলোতে দেখা যায়। উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও সুক্ষ্ম ও মসৃন শীতলপাটির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় উৎপাদন অপ্রতুল। শীতলপাটি হস্তশিল্পকে টিকিয়ে রেখেছে গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জের বনাঞ্চল। প্রাকৃতিকভাবে বনবিভাগের জমিতে মুর্তা চাষ হয়ে আসছে দীর্ঘকাল থেকে। গাছ ও বাঁশ মহালের মত মুর্তার মহাল থেকে সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলের শীতলপাটি শিল্পের সাথে জড়িত ব্যক্তিরা মুর্তা ক্রয় করেন। অনেকে নিজেদের ক্ষুদ্র পরিসরে মুর্তাচাষ করলেও চাহিদার তুলনায় নগন্য। ফলে মহাল থেকে মুর্তা ক্রয় করতে হয়। বর্তমানে সিলেটের ছাতক বনরেঞ্জের অধিনে ২‘শ একর পতিত জমিতে মুর্তা বনায়ন করেছে বনবিভাগ। বন বিভাগের এ উদ্যোগ শীতলপাটি হস্তশিল্পের জন্য সহায়ক হবে নিঃসন্দেহে।
সিলেট ছাড়াও মৌলভীবাজারের রাজনগর, শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ, কুলাউড়া উপজেলায় শীতলপাটি হস্তশিল্প রয়েছে। বিশেষ করে এ শিল্পের সাথে জড়িত হিন্দু সম্প্রদায়ের দাশগোত্র। বর্তমানে এ পেশায় মুসলমানদের কুটির শিল্পে দক্ষ ব্যক্তিরাও জড়িত রয়েছে।
বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খন্দকার মুদাচ্ছির বিন আলী বলেন, ‘পাটি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে এর সাথে জড়িতদের প্রশিক্ষণের দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যাতে তাদের আধুনিক বিপণন ব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত করা ও বাজার ধরে রাখা যায়। সাথে সাথে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এক্সপোর্ট মার্কেটে যাতে যেতে পারে সে লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে শিল্পটাকে ধরে রাখে। তাই তরুণদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।’
পর্যাপ্ত পৃষ্টপোষকতা পেলে মুর্তা বেতের চাষাবাদ বৃদ্ধির মাধ্যমে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটি হস্তশিল্পকে লাবজনক শিল্পে পরিনত করা সম্ভব। সরকারী ও বেসরকারীভাবে পুজি ও পৃষ্টপোষকতা ও সহজ শর্তে ঋনসুবিধা দেওয়া হলে এ শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে বেকারদের যেমন হবে কর্মসংস্থান, তেমনি শীতলপাটি বিদেশে রপ্তানীর মাধ্যমে সরকারও পাবে বিপুল পরিমান রাজস্ব। শীতলপাটি হস্তশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন জরুরী। #

সংবাদটি শেয়ার করুন