আজ ৭ ডিসেম্বর। ইতিহাসের খাতায় শাল্লা মুক্তদিবস। দিনটি ভাটির হাওরাঞ্চলের জন্য চিরস্মরণীয়,তাৎপর্যপূর্ণ ও ঐতিহাসিক দিন। ইতিহাস বলছে ১৯৭১ সালের এইদিনে হাওর বেষ্টিত জনপদ শাল্লা থানা পাকহানাদার বাহিনী হতে মুক্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধাগণ মহাআনন্দে বিজয় পতাকা উত্তোলন করে শাল্লাকে শত্রু মুক্ত ঘোষনা করেন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে পাক-হানাদার বাহিনী এই দিনে শাল্লা উপজেলা সদর ঘুঙ্গিয়ারগাওঁয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট আত্মসমর্পন করে। দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর। প্রায় কয়েক ঘন্টা ব্যাপী সন্ধ্যা-সময় আনুমানিক ৫টা হতে রাত ৮টা পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলে। জায়গাটি ছিল সদর ঘুঙ্গিয়ারগাওঁ এর অদূরে উজানযাত্রাপুরের তিননাথ গাছের আড়াল। এই যুদ্ধে দুই রাজাকার ও তিন পাকবাহিনী নিহত হয়। পরেরদিন ৭ ডিসেম্বর নয় পাকবাহিনী সহ প্রায় চারশত রাজাকার থানা সদর মাঠে আত্মসমর্পণ করে। তাদের ঘাটিছিল শাহীদ আলী স্কুল সংলগ্ন ডুমরা গ্রামের রামকৃষ্ণ আখড়া। এমনই যুদ্ধবিজয়ের কথা শোনিয়ে ছিলেন (২২/১১/২০১৯) তৎকালীন সময়ের তরুণ, গোবিন্দপুরের সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা সুকুমার বাবু(বর্তমানে ভারতের পুণে)। তখন তারিখ স্মরণ করতে না পারলেও শুধু বলছিলেন যাত্রাপুরের যুদ্ধ! যাত্রাপুরের যুদ্ধ! এরপর হতে ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর ‘শাল্লা মুক্তদিবস’ পালনের তারিখ ইতিহাস সিদ্ধ হলেও কবে হতে এর আনুষ্ঠানিক পালনের যাত্রা শুরু হয়েছে তা এখনও পাওয়া যায়নি। তবে তার আগেও ৫জুলাই ১৯৭১ সালে শাল্লা থানা সফল অপারেশন হয়েছিল সাংবাদিক সালেহ চৌধুরীর নেতৃত্বে(দাস পার্টির খোঁজে পৃ-২১)। সিলেট জেলার শাল্লা ছিল সুনামগঞ্জ মহকুমার অধীন নিম্নাঞ্চল। রাষ্ট্রীয় পরিসীমায় ৪টি ইউনিয়ন। চতুর্দিকে হাওর,বোরজমি,বিল,ছন কান্দা,চালিয়ার কান্দা একধরনের সড়ক বিহীন অঞ্চল। জনবসতিপূর্ণ গ্রামগুলোর অবস্থাও ছিল থোকা থোকা। অনেক লেখকগনের মতে দুর্গম জনপদ হিসেবে আখ্যায়িত। হেমন্তে শুধু পা আর বর্ষায় হাতে বাউয়া নৌকা বিহীন মানুষের চলাচল তেমন একটা চোখে পড়তো না। তবে যোগাযোগের দ্বার হিসেবে এর তিন সীমানায় আজমিরিগঞ্জ,মার্কুলী দিরাইয়ে লঞ্চ,স্টীমার এসব ব্যবহার করতো। তারমানে তৎকালীন কলকাতা,রাউয়ালপিন্ডি,ইসলামাবাদ,ঢাক্কা এসব নগরের সাথে যোগাযোগ বা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় যোগাযোগ এমনিতেই বুঝা যাচ্ছে। মহকুমা শহর সুনামগঞ্জ হলেও সাধারণ মানুষের চলাচলের দ্বার হিসেবে আজমিরিগঞ্জকে অধিক প্রাধান্য দিতো। জানাযায় ঐ সময়ে শাল্লা থানার ৪টি ইউনিয়নের মধ্যে একমাত্র হবিবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছাড়া বাকী ৩টি ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ছিল স্বাধীনতা বিরোধী পাকিবাহিনীদের রক্ষকদার রাজাকার ও শান্তি কমিটির শিরোমনিদের অন্যতম। তখন বাহারা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ছিল শরাফত আলী(সুলতানপুর), শাল্লা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ছিল কালাই মিয়া চৌধুরী(মনুয়া), আটগাঁও ইউনিয়ন চেয়াম্যান ছিল আব্দুল খালেক(দৌলতপুর)। এমনই তথ্য পাওয়াযায় বিভিন্ন লেখক,গবেষকদের লেখা ও বইয়ে। তাদের অত্যাচারে হাওরের আকাশ বাতাস কেঁদেছে। ঘর জ্বালানি,দখল,লুট মহিলাদের ওপর নির্যাতন চলে নির্বিচারে। গ্রামের পর গ্রাম অগ্নি সংযোগে ছারখার হলেও অন্যান্য ইউনিয়নের ন্যায় শুধু বাহারা ইউনিয়নেই ৩০টি গ্রাম লুটপাট করে পাকসেনা ও তাদের দোসররা। এর মধ্যে আঙ্গারুয়া,হরিনগর,নওয়াগাঁও(আঙ্গারুয়া),সুখলাইন, যাত্রাপুর,ভেড়াডহর,মেদা,মুক্তাপুর,হরিপুর, নাইন্দা,মেঘনাপাড়া,মোহনাপল্লী, সুধনখল্লী ও রূপসাগ্রাম সম্পূর্ণভাবে পুড়ে ছারখার করে দেয়া হয় এবং পুড়ারপাড়,কান্দখলা,ডুমরা,ঘুঙ্গিয়ারগাওঁ পোড়ানোতে আংশিক ক্ষতি হয়। এছাড়াও পাকসেনা ও তাদের দোসর রাজাকার,আলবদরদের গুলিতে বা নির্যাতনে প্রায় ২০জন নিহত হয় (রক্তাক্ত-৭১,পৃ-১৭২/১৭৩)। পাকসেনাদের কবল হতে দেশমাতাকে বাঁচাতে মুক্তিযোদ্ধারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে গ্রামের সাধারণ মানুষদের মুক্তিযুদ্ধে যেতে উদ্ভুদ্ধ করনে অ্যাডঃ সুরেশ দাশকে প্রদর্শনী করতেন((তখন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র),তাঁর ঘাড়ে গুলি লাগা দেখাতেন,ক্ষত দেখাতেন(সালেহ চৌধুরী,ভাটি এলাকার মুক্তিযুদ্ধ,পৃ-৬৪/৬৫)। আরেক মুক্তিযোদ্ধা আটগাওঁ নিবাসী মতিউর রহমান চৌধুরী যিনি সশস্ত্র ট্রেনিং করিয়ে প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়ে দিতেন(সুনামগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধ, পৃ-১১৪/১১৫)। গেরিলা বাহিনীর অন্যান্যদের ন্যায় বীরমুক্তিযোদ্ধা প্রভাশু চৌধুরী, কমরেড শ্রীকান্ত দাশ’রা গ্রামে গ্রামে টহল দিতেন। লুটতরাজ,অগ্নি সংযোগকারীদের ধরে ধরে মারতেন (স্মৃতিতে-৭১,প্রকাশকাল-২৬মার্চ ২০১২)। এমন মুক্তিযোদ্ধাদের ভীড়ে(অধিকাংশ প্রয়াত),কেউ কেউ পলাত, কেউ কেউ নিরুপায় এমতাবস্থায় রাষ্ট্রীয় শোডাউনের নমুনায় আজ যখন শত শত মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের সন্তান কমান্ড ও রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিত্বকারীদের উপস্থিতিতে বর্ণাঢ্য রেলী করে প্রদর্শনী করে,জাতির পিতার মোড়ালে পুষ্প দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে, শহীদদের স্মরণে ও শ্রদ্ধায় কিছু সময় নিরবতা পালন করে তখনই প্রশ্ন আসে মুক্তিসেনাদের সেদিনের এতোসব বীরত্ব, অবদানকে পাশ কাটিয়ে হাওর এলাকায় স্বাধীনতা বিরোধীরা সরকারি দলের কুটকৌশলে কিভাবে স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার কালাইয়ের নামে বিদ্যাপীঠ গড়ে ওঠে? যুদ্ধাপরাধ মামলা ও ৭১-র স্বাধীনতা বিরোধী পরিবারের সন্তান ‘গোবিন্দ চন্দ্র বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়’য়ে কিভাবে শিক্ষক নিয়োগ করে (সরকারী করনের আগে)? বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায়, কিভাবে রাজাকারের সন্তানরা জায়গা করে? তাই আজ ইতিহাসবিদদের কাছেই প্রশ্ন ছোঁড়তে হয় শাল্লা কি আসলেই ৭১-র শত্রু মুক্ত হয়েছে না শুধু দিবস উদযাপনের জন্য মক্তদিবস পালন হবে? #
লেখক- সুশান্ত দাস। লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব সদস্য,লন্ডন যুক্তরাজ্য।