• ১৯শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ৬ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ২১শে শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

বিশেষ সাক্ষাৎকার: সন্তান ও পরিবার এবং নিজের জীবন বাঁচাতে এক শিক্ষকের আকুতি

Daily Jugabheri
প্রকাশিত জুন ৮, ২০২৪
বিশেষ সাক্ষাৎকার: সন্তান ও পরিবার এবং নিজের জীবন বাঁচাতে এক শিক্ষকের আকুতি

শফিকুর রহমান, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি :
দেশে কিশোর গ্যাং কালচার এক ভয়াবহ ব্যধি! যা সাম্প্রতিক সময়ে প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ কালচারে বিপথগামী শিশু-কিশোররা অপরাধ সংঘটনে জড়িয়ে পড়ছে। চাঁদাবাজি, ছিনতাই, দখল বাণিজ্য, মাদকের ব্যবসাসহ তাদের অপরাধমূলক এসব কাজের কারণে এবং অপরাধপ্রবণতায় ধ্বংসের মুখোমুখি হচ্ছে বহু পরিবার। নষ্ট হচ্ছে সামাজিক শৃঙ্খলা। গ্যাং কালচারে গ্রুপ-ভিত্তিক সংঘর্ষের কারণে অনেক তরুণের প্রাণ ঝরার খবর প্রতিনিয়ত সংবাদ মাধ্যমে চোখে পড়ছে। কিন্তু এসব নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর আইন প্রয়োগে শিথিল মনোভাবে দিন দিন বাড়ছে কিশোর অপরাধ। এমন পরিস্থিতি এখন সারাদেশের। ব্যতিক্রম নয় সীমান্ত জেলা মৌলভীবাজার।

এ জেলার বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে ভয়ংকর গ্যাং কালচার। এর মধ্যে ভয়ংকর হচ্ছে ‘বিটিকবাজ গ্রুপ’।

মৌলভীবাজার জেলার বিটিকবাজ গ্রুপের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত একটি পরিবারের অসহায় পিতা হচ্ছেন শিক্ষক ফয়জুর রহমান।  গত ৭ জুন ২০২৪ ইংরেজি মৌলভীবাজার জেলা সদরে অবস্থিত যুগভেরীর স্থানীয় অফিসে তার (ফয়জুর রহমান) জীবনের নানা দুঃসহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন। এ বর্ণনায় তিনি তার সন্তান, পরিবার ও জীবন রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট আকুতি জানিয়েছেন।

শিক্ষক ফয়জুর রহমান বলেন, আমার ছেলে নুরুল ইসলাম এলাকার স্থানীয় বাজারে ‘স্বপ্ন সুপার শপ’ এর ব্যবসার সাথে জড়িত এবং বড়লেখা যুব সংঘের হয়ে সামাজিক বিভিন্ন কাজের সাথে যুক্ত রয়েছে। গত ৩ জানুয়ারি ২০২৩ ইংরেজি তারিখে এলাকার ‘বিটিকবাজ গ্রুপ’ নামের কিশোর গ্যাং আমার ছেলে নুরুল ইসলামকে টার্গেট করে তাদের দলভুক্ত করতে প্রস্তাব দেয়। তবে তাদের দলনেতা ও স্থানীয় ছাত্রলীগের সভাপতি জাকেরের ঐ প্রস্তাব আমার ছেলে নুরুল ইসলাম প্রত্যাখ্যান করে। পরে তারা আমার ছেলের নিকট থেকে জোরপূর্বক ৮৫,০০,০০০/- (পঁচাশি লক্ষ টাকা) চাঁদা আদায় করে।

চাঁদা আদায় করেও তারা থেমে থাকেনি। আরও চাঁদা দাবি করতে থাকে। তবে আমার ছেলে চাঁদা দিতে অপরাগতা প্রকাশ করে। এতে তারা (বিটিকবাজ গ্রুপ) প্রচ- ক্ষিপ্ত হয়। তারা গত ১০ জানুয়ারি ২০২৩ ইংরেজি তারিখে ফোনে আমার ছেলেকে হত্যার হুমকি দেয়। তাতেও চাঁদা না পেয়ে ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ইংরেজি তারিখে আমাদের বাড়িতে সন্ত্রাসী বাহিনী পাঠিয়ে হামলা ও ভাঙচুর চালায় এবং ফের ৫০ লক্ষ টাকা চাঁদা দাবি করে। এ অবস্থায় আমার পরিবারের লোকজন আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। সবসময় আমরা আতঙ্কে থাকতাম। এরকম পরিস্থিতিতে আরও কিছুদিন চলে যায়।

শিক্ষক ফয়জুর রহমান আরও বলেন, সব কিছু ভালোভাবে চলছিল। তবে আমাদের পরিবারের জন্য ভয়ংকর দিন হিসেবে হাজির হয় ১২ মার্চ ২০২৩ইং তারিখ। এদিন কিশোর গ্যাং বিটিকবাজ গ্রুপের সদস্যরা একা পেয়ে আমার ছেলে রাস্তায় আক্রমণ করে। দেশীয় অস্ত্র (লাঠি-সোটা) দিয়ে আমার ছেলে বেধড়ক মারপিট করে তারা। এতে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এতে আমার ছেলে মারা গেছে ভেবে তারা ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। স্থানীয় লোকজনের মাধ্যমে খবর পেয়ে আমি আমার ছেলেকে উদ্ধার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করাই। কিছুদিনের মধ্যে সুস্থ হয়। তবে এই গ্যাং গ্রুপের রোষানলে পড়ি আমরা। তারা এখন আমাদের ভয়ভীতি, পুরো পরিবারকে প্রাণে হত্যা ও নির্যাতন করবে বলে হুমকি দিতে থাকে। এ অবস্থায় প্রাণ রক্ষার্থে আমার ছেলে নুরুল ইসলাম এলাকা ছেড়ে বরিশাল, ঢাকা ও গাজীপুরে আত্মগোপন করে। তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি।

ফয়জুর রহমান বলেন, এ সন্ত্রাসীরা গত ২৬ মে ২০২৩ ইংরেজি তারিখে বরিশালের ভাড়া বাসায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে ও নুরুল ইসলামকে হত্যার হুমকি দেয়। পরবর্তীতে গত ১৫ জুলাই ২০২৩ ইংরেজি তারিখে আমার ছেলে নুরুল ইসলামকে না পেয়ে আমার উপর চাপ প্রয়োগ করে বিটিকবাজ গ্রুপ। তারা চাপ দিয়ে আমার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করে। তাতেও ক্ষান্ত হয়নি ওই সন্ত্রাসীরা। তারা (সন্ত্রাসীরা) গত ২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ইংরেজি তারিখে ঢাকায় আত্মগোপন থাকা অবস্থায় কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে নুরুল ইসলামকে গুম করে। পরে আমার ছেলেকে নির্মাণাধীন নির্জন বাড়িতে আটকে রেখে নির্যাতন চালায়। এতে ছেলের বুকে ও পায়ে জখম হয়। স্থানীয় লোকজন বিষয়টি বুঝতে পেরে এগিয়ে গেলে তারা তাকে ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে তার চিকিৎসা হয় বেশ কয়েকদিন। এমতাবস্থায় আমি ছেলের জীবন রক্ষার্থে এবং নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে নুরুল ইসলামকে কানাডায় পাঠিয়ে দেই। ছেলেকে কানাডায় পাঠিয়ে আমি ও আমার পরিবার মনে করেছিলাম হয়তো আমরা এবার নিরাপদ হয়েছি।

তিনি (ফয়জুর রহমান) আরও বলেন, ছেলে পাঠিয়ে নিরাপদ থাকাটা আমাদের বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। গত ৯ মার্চ ২০২৪ ইরেজি তারিখে উক্ত সন্ত্রাসী জাকের ও তার সঙ্গীয় লোকজন আমার ছেলে নুরুল ইসলামকে না পেয়ে আমাদের বাড়িতে এসে ভাঙচুর চালায় এবং ৫০ লক্ষ টাকা চাঁদা দাবি করে। এ ঘটনায় ঐ দিনই আমি এ বিষয়ে মামলা করতে থানায় যাই। তবে তাদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ও প্রভাব থাকায় থানা পুলিশ কোনো মামলা গ্রহণে রাজি হয়নি।

ফয়জুর রহমান বলেন, বিটিকবাজ গ্রুপের নেতাদের সাথে থানা পুলিশের সখ্যতা আছে। থানা পুলিশের সহযোগিতায় তারা সকল অপকর্ম করে এবং চাঁদার টাকা পুলিশের সাথে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়। এহেন পরিস্থিতিতে আমি গত ১১ মার্চ ২০২৪ ইংরেজি তারিখে বিষয়টি নিয়ে নোটারী পাবলিক বাংলাদেশের মাধ্যমে এফিডেভিট করি।

তিনি আরও অভিযোগ করে বলেন, উক্ত বিটিকবাজ গ্রুপের নেতা জাকের আমার ছেলে নুরুল ইসলামকে খুঁজে বের করে চাঁদা আদায় করার জন্য র‌্যাব ও পুলিশের সহায়তায় মামলা করার হুমকি দিচ্ছে। এতে আমরা ভয়ে আছি। কারণ এরা পারে না এমন কোনো কাজ নাই। যে কোনো সময় তারা আরও বড় দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে। তাই আমি আমার সন্তান, পরিবার ও জীবন রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট আকুতি জানাচ্ছি।

শুধু এই শিক্ষক পিতার আকুতি নয়। বিশেষজ্ঞগণও কিশোর গ্যাং কালচার নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সরকারকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে অনুরোধ করেছেন। গত ৮ মার্চ ২০২৪ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এক আলোচনায় বলেন, সরকারের পালাবদল হয়; কিন্তু কিশোর তরুণরা সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ পায় না। রাষ্ট্র মানবিক হচ্ছে না। খুনিরা চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিশোররা নিরাপত্তাহীন। খুনের বিচার না হলে গণতন্ত্র হবে না। গত ২০১৩ সালে নারায়ণগঞ্জের খুনের শিকার কিশোর তানভীর মো: ত্বকির ২৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে একথা বলেন।

প্রসঙ্গত, সারাদেশে ২৩৭ কিশোর গ্যাং বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা এখন আতঙ্কের নাম। গেল অর্ধ যুগে তাদের হাতে বহু হত্যাকা- ঘটেছে। গত ১৮ মে ২০২৪ ইংরেজি তারিখে জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে আসে।

সংবাদটি শেয়ার করুন