যুগভেরী রিপোর্ট
চারপাশে ধানি জমি। ফাঁকে ফাঁকে জলমগ্ন ডোবাও আছে। ডোবা আর ধানক্ষেত পেরোলে বাঁশবাগান-ঝোপঝাঁড়। কোনো সড়ক নেই। ক্ষেতের আলপথ ধরে বাঁশবাগান পেরিয়ে সামনে গেলেই দেখা মিলে একটি বাড়ির।
বাড়িটির বড় উঠানের শেষ প্রান্তে টিন ও বাঁশ দিয়ে তৈরি সাধারণ একটি ঘর। ভাঙাচোরা ঘর। দারিদ্রতার ছাপ স্পষ্ট।
আপাতঃ সাধারণ এই বাড়ির একটি বিশেষত্ব আছে। এই একটি বাড়ি নিয়েই গড়ে উঠেছে একটি গ্রাম। গ্রামের নাম শ্রীমুখ। সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার খাজাঞ্চি ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডে অবস্থান এই গ্রামের।
পরিসখ্যান ব্যুরোর নথি ও ভোটার তালিকায়ও রয়েছে একটি পরিবার নিয়ে গড়ে ওঠা এই গ্রামের নাম। শ্রীমুখ দেশের তো বটেই, এমনকি বিশ্বেরও সবচেয়ে ছোট গ্রাম বলে দাবি করছেন গবেষকরা।
যদিও সরকারি নথিতে, সবচেয়ে ছোট গ্রাম হিসেবে আলাদা করে কোনো উল্লেখ নেই। তবে সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, নথিপত্র ঘেঁটে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেলে শ্রীমুখকে সবচেয়ে ছোট গ্রাম হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
কোথায় শ্রীমুখ
সিলেটের সর্বপশ্চিমের উপজেলা বিশ্বনাথ। প্রবাসীবহুল এলাকা হিসেবে পরিচিতি রয়েছে এই উপজেলার। যদিও এখানকার বিপুল সংখ্যক জনগোষ্টির অবস্থান দারিদ্রসীমার নিচে। উপজেলা সদর থেকে রামপাশা হয়ে ২০ মিনিট এগোলেই পৌঁছানো যাবে খাজাঞ্চি ইউনিয়নের শ্রীমুখ গ্রামে। তেলিকোনা ও পশ্চিম নোয়াগাও নামে দুটি গ্রামের মধ্যিখানে অবস্থান শ্রীমুখের।
এই গ্রামের আয়তন মাত্র ৬০ শতক। গ্রামের লোকসংখ্যা মোট চারজন। একই পরিবারের সদস্য তারা। এরমধ্যে পরিবারের একমাত্র পুরুষ সদস্য দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে। বাকী তিনজনের মধ্যে দুজন নারী ও একজন শিশু। সর্বশেষ ভোটার তালিকায় এই গ্রামে ভোটার রয়েছেন দুজন।
পরিসখ্যান ব্যুরোর নথিতে শ্রীমুখ গ্রামের নাম উল্লেখ থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করে এই দপ্তরের সিলেট কার্যালয়ের উপ পরিচালক মুহাম্মদ আতিকুল কবীর বলেন, সর্বশেষ জরিপ অনুসারে বিশ্বনাথের শ্রীমুখ গ্রামে একটি পরিবার রয়েছে। আর লোকসংখ্যা রয়েছেন ৪ জন।
সবচেয়ে ছোট গ্রাম
আনুষ্ঠানিক কোনো স্বীকৃতি নেই, তবে গবেষকরা মনে করছেন আয়তন ও লোকসংখ্যার দিক দিয়ে শ্রীমুখই বিশ্বের সবচেয়ে ছোট গ্রাম।
এই গ্রাম নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তথ্য তালাশ করছেন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের পলিটিকাল স্ট্যাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. জহিরুল হক শাকিল।
তিনি বলেন, একটি মৌজা নিয়েই শ্রীমুখ গ্রাম। দাগ, খতিয়ান এবং মৌজাসহ সরকারি সকল নথিপত্রে শ্রীমুখ আলাদা গ্রাম হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। এর আয়তন ৬০ শতক ও লোকসংখ্যা ৫ জন। ফলে এটি দেশের সবচেয়ে ছোট গ্রাম তো বটেই এমনকি বিশ্বেরও সবচেয়ে ছোট গ্রাম।
তিনি বলেন, এখন বিশ্বের সবচেয়ে ছোট গ্রাম ধরা হয় ক্রোয়েশিয়ার ‘হাম’ কে। সেখানকার জনসংখ্যা ৩০ জন। এবং আয়তনে শ্রীমুখ থেকে অনেক বড়।
বিশ্বের সবচেয়ে ছোট গ্রাম হিসেবে শ্রীমুখের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য সরকারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত উল্লেখ করে জহিরুল হক শাকিল বলেন, এতে এই গ্রামের পরিচিত বাড়বে। পর্যটকদের জন্যও গ্রামটি আকর্ষনীয় হয়ে উঠবে।
বিশ্বনাথ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুমন চন্দ্র দাশ বলেন, এই গ্রামটির ব্যাপারে আমি শুনেছি। সম্প্রতি বিশ্বনাথের সহকারী কমিশনার (ভূমি) কে ওই গ্রাম পরিদর্শন করেছেন। আমরা এখন বিভিন্ন নথিপত্র জোগাড় করছি। তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেলে শ্রীমুখকে সবচেয়ে ছোট গ্রাম হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করা হবে।
এ প্রসঙ্গে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আসলাম উদ্দিন বলেন, পরিসখ্যান বিভাগের তথ্যে এটি আলাদা গ্রাম হিসেবেই উল্লেখ আছে। এই গ্রামে মাত্র একটি পরিবার রয়েছে।
ছোট গ্রাম হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের উদ্যোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি আমাদের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া কিছুটা ঝামেলার এবং অনেক সময়সাপেক্ষ। তবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা আসলে এটি দ্রুততম সময়ে সম্ভব হবে। আমাদের পক্ষেও তখন কাজ করতে সুবিধা হবে।
তবে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য ইতোমধ্যে তৎপরতা শুরু করেছেন জানিয়ে বিশ্বনাথ উপজেলা চেয়ারম্যান এসএম নুনু মিয়া বলেন, আমি পরিকল্পনামন্ত্রীর সঙ্গে এ গ্রাম নিয়ে কথা বলে এসেছি। শ্রীমুখ গ্রামটিকে কীভাবে বিশ্বের সবচেয়ে ছোট গ্রাম হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করা যায় এ ব্যাপারে উদ্যোগি নিতে তাকে অনুরোধ করেছি। তিনি আমাকে আশ^স্ত করেছেন।
গ্রাম কিভাবে গড়ে উঠলো
৩২ দশমিক ৪৩ বর্গমাইল আয়তনের বিশাল ভ’খন্ডের বানিয়াচং। হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচংও একটি গ্রাম। বিশে^র সবচেয়ে বড় গ্রাম। আবার ৫ সদস্যের একটি পরিবার নিয়ে ৬০ শতক এলাকার শ্রীমুখও একটি গ্রাম।
উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে গ্রাম আছে ৮৭ হাজার ১৯১টি। এসব গ্রামে গড়ে ২৩২টি পরিবার বাস করে।
তবে গ্রামভেদে আয়তন ও লোকসংখ্যার বিশাল তারতম্য দেখা যায়। গ্রামগুলো আসলে গড়ে উঠেছে কিভাবে?
শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিকাল স্ট্যাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. জহিরুল হক শাকিল বলেন, পরিবারের পরে সবচেয়ে প্রাচীন প্রািতষ্ঠান হলো গ্রাম। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে বৃটিশরা দেশের সমগ্র এলাকাকে আলাদা আলাদা গ্রামে ভাগ করার উদ্যোগ নেয়। ১৮৪৭ সাল থেকে ১৮৫৯ সালের মধ্যে গ্রামগুলোর সীমানা চিহ্নিত করা হয়। স্থানীয় জমিদার, খাজনা আদায়কারীদের সক্ষমতা অনুযায়ী একেক গ্রামের আয়তন একেক রকম হয়। তবে গ্রামের জন্য আয়তন বা জনসংখ্যার নির্ধারিত কোনো সীমা নেই।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আসলাম উদ্দিন বলেন, স্থানীয় বাসিন্দারা নিজস্ব স্টাইলেই গ্রাম গড়ে তুলেছেন। কেউ কেউ হয়তো একটা এলাকাকে পরিষ্কার করে বসবাস করা শুরু করলেন, তারপর ওই এলাকাকে একটি নাম দিয়ে গ্রাম হিসেবে উল্লেখ করলেন। বেশিরভাগ গ্রামই এভাবে তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, সরকারি উদ্যোগে গ্রাম গঠনের সুযোগ নেই। সরকার ইউনিয়ন পরিষদ গঠন করে গ্রামগুলোকে একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে এসেছে। গ্রাম গঠিত হয়েছে তার নিজস্ব স্টাইলে।
স্থানীয়রা কী বলেন
শ্রীমুখ গ্রামে এখন বসবাস করেন আপ্তাব আলীর পরিবার। আপ্তাব আলী সৌদি প্রবাসী। তার স্ত্রী সন্তান ও বোন এখন বাড়িতে থাকেন। এরআগে এই বাড়ি ছিলো একটি হিন্দু পরিবারের। তথ্য মতে, ১৯৬৪ সালে তারা আপ্তাব আলীর দাদা হাবিব উল্লাহ’র কাছে বাড়ি ও জমি বিক্রি করে ভারতে চলে যান। দাদার কাছ থেকে এই বাড়ি পান আপ্তাব আলী। এরপর থেকে সেখানে তাদের বসবাস।
ওই বাড়িতে গিয়ে কথা হয় আপ্তার আলীর স্ত্রী রাহিমা বেগমের সাথে। গ্রামের ইতিহাস সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না। বিয়ের পর থেকেই এ বাড়িতে ববাস করছেন বলে জানান রহিমা।
রহিমা বেগম বলেন, আমরার একটা বাড়ি লইয়াই আমরার গ্রাম। এক বাড়ি লইয়া কিলা গ্রাম অইলো ইটা আমি জানি না।
স্থানীয় প্রবীন বাসিন্দা, খাজাঞ্চি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আইনজীবী আব্দুর রশিদ বলেন, শুনেছি ব্রিটিশ আমলে এখানে একটি হিন্দু পরিবার বসবাস করতো। পরে হিন্দু পরিবারটি অন্যত্র চলে যায়। এসময় পাশের পশ্চিম নোয়াগাওঁ গ্রামের আব্দুল গনির পিতা মরহুম হাবিব উল্লাহ এই বাড়িটি ক্রয় করেন।। পরবর্তিতে শ্রীমুখ গ্রামের বাড়িটি হাবিব উল্লাহ তার মেয়ে কটাই বিবিকে দান করেন। এরপর কটাই বিবি স্বামী আব্দুল রহমানকে নিয়ে এ বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। কটাই বিবি ও তার স্বামী মারা যাওয়ায় পর ছেলে আপ্তাব আলী বর্তমানে এ বাড়িতে রয়েছেন।
অধ্যাপক জহিরুল হক শাকিল বলেন, গ্রামটির আয়তন আগে হয়তো অনেক বেশি ছিলো। সম্ভবত নদীভাঙ্গনে কিছু এলাকা তলিয়ে গেছে। অন্য গ্রামের লোকদের কাছে বিক্রি করার ফলে এই গ্রামের জায়গা অন্য গ্রামের অন্তভর্’ক্তও হয়ে যেতে পারে। এছাড়া আগে এখানে একাধিক পরিবারও বসবাস করে থাকতে পারেন। তবে ১৯৬৪ সালের পাওয়া হিসেবে এখানে একটি পরিবারই ছিলো।
শ্রীহীন শ্রীমুখ
গ্রামে প্রবেশের নিজস্ব কোনো সড়ক নেই। হেমন্তে অন্যের জমির আলপথ পেরিয়ে আর বর্ষায় কিছুটা নৌকায় করে ও কিছুটা কাদামাটি পেরিয়ে যেতে হয় শ্রীমুখ গ্রামে।
গ্রামের বাসিন্দা আপ্তার আলীর স্ত্রী রাহিমা বেগম বলেন, আমাদের বাড়িত ঢুকার কোনো রাস্তা নাই। আরোকজনোর জমিনোর উপর দিয়া আইতে অয়। বাইচ্চার স্কুলো যাইতে খুব সমস্যা অয়। আর বর্ষার সময় তো পানিত বন্দি থাকি।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, একটামাত্র বাড়ি হওয়ায় আমরার গ্রামোর উন্নয়নোর কথা কেউ জিন্তা করইন না।
এই গ্রামের দুরাবস্থা প্রসঙ্গে খাজাঞ্চি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তালুকদার মো. গিয়াস উদ্দিন বলেন, গ্রামের একটিমাত্র বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁচেছে। তাদের প্রধান সমস্যা এখন নিজস্ব সড়ক না থাকা। কিন্তু বাড়ির চাপাশে অন্যের ব্যক্তিমালাকাধীন জমি। ফলে চাইলেই সড়ক নির্মাণ করা সম্ভব নয়।
ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, জমির মালিকরা যদি একটু জমি ছেড়ে দেন তাহলে ইউনিয়ন পরিষদ থেকেব সড়ক তৈরি করতে উদ্যোগ নেবো।