তোফায়েল আহমদ :
সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কয়েছ এর মৃত্যুতে সিলেট-৩ (দক্ষিণ সুরমা-ফেঞ্চুগঞ্জ-বালাগঞ্জ) আসন নির্বাচন কমিশন শূণ্য ঘোষণা করে। পরে ২৮ জুলাই ২০২১ ইংরেজী উক্ত আসনে ভোট গ্রহনের তারিখ নির্ধারণ করে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনী প্রচারণায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা উক্ত আসনে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ করেন এবং বিভিন্ন গোন্দেয়া সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী হাবিবুর রহমান হাবিব পরাজিত হবার আশংকা দলীয় সভানেত্রী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা কমিটির কাছে রিপোর্ট প্রদান করে। পরে দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী করোনার দোহাই দিয়ে নির্বাচনের কয়েক দিন আগে নির্বাচন কমিশন দ্বারা নির্বাচন স্থগিত করা হয়। তখন জাতীয় পার্টির পদপ্রার্থী আতিকুর রহমান আতিক বিজয়ী হবার সম্ভাবনা ছিলো। পরবর্তীতে নির্বাচন কমিশন ৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ পুনরায় ভোট গ্রহনের তারিখ নির্ধারণ করে। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী করার লক্ষে সকল কলা কৌশল তৈরী করে ক্ষমতাসীন দল। নির্বাচনে সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী আতিকুর রহমান আতিক (জাতীয় পার্টি), আলহাজ শফি আহমদ চৌধুরী (স্বতন্ত্র), জুনাইদ মোহাম্মদ মিয়া (বাংলাদেশ কংগ্রেস)। তারা আশংকা প্রকাশ করে বলেন এই নির্বাচন এক তরফা হবে এবং ক্ষমতাসীন দল সরকারি প্রভাব খাটিয়ে জোরপূর্বক নৌকার প্রার্থীকে বিজয়ী করবে।
ভোটের দিন ৪ সেপ্টেম্বর সকাল ৬টা থেকে সিলেট-৩ (দক্ষিণ সুরমা-ফেঞ্চুগঞ্জ-বালাগঞ্জ) ১৪৯টা ভোট সেন্টার দখল করে নেয় সরকারদলীয় কর্মীরা। দক্ষিণ সুরমা উপজেলার সৈয়দ কুতুব জালাল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিলাম, জালালপুর, লালাবাজারসহ বেশ কয়েকটি সেন্টার দক্ষিণ সুরমা উপজেলা সেচ্ছাসেবক লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ এর নেতারা কেন্দ্র দখল করে নেয়। সকাল ৮টা থেকে তাদের অনুসারী নেতা কর্মীরা ভোট কেন্দ্রে আসা সাধারণ মানুষকে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে হুমকি ধমকি ও চাপ দিতে থাকে। সাধারণ ভোটারা অপাগতা প্রকাশের করলে তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে হয়রানি করে কেন্দ্র থেকে বাহির করে দেয়। সৈয়দ কুতুব জালাল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের ভোটার জনাব জামাল আহমদ জানান, তিনি সকালে ভোট কেন্দ্রে আসলে নির্বাচন কর্মকর্তা সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে গোপন কক্ষ গিয়ে ভোট দেয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তুু গোপন কক্ষ দখলে থাকা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জাবেদ আহমদ উনার ভোট নৌকায় দিয়ে দেন। তিনি প্রতিবাদ করলে ভোট কেন্দ্র থেকে মেরে বাহির করে দেন। তিনি নির্বাচন কর্মকর্তাকে জানালে কোন সহযোগীতা না করে পুলিশ ডেকে কক্ষ থেকে বাহির করে দেন। এই রকম যত ভোটার এসেছেন জাবেদ আহমদের অনুসারীরা তাদের ফিঙ্গার রেখে বলত তুমার ভোট হয়েগেছে চলে যাও। শেলি বেগম অভিযোগ করেন ভোট দিতে গিয়ে তিনি হামলার স্বীকার হয়েছেন এবং ফিঙ্গার দেওয়ার পর ভোট দিতে পারেন নাই তিনি। দিন শেষে দেখা যায় যে ফলাফলের সময় একতরফা ভাবে এই কেন্দ্রে নৌকা বিজয়ী হয়। এই কেন্দে ৭২৭টি ভোট কাষ্ট হয় তার মধ্যে নৌকা ৬৭৯ টা, ডাব ১ টা , মটর গাড়ি ১১ টা, লাঙ্গল ৩৬ টা।
সিলাম কেন্দ্রের ভোটার সৌরভ বলেন, ১১টার দিকে ভোটকেন্দ্রে গেলে অনেক ভোটার লাইনে দাড়ানো। হঠাৎ করে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে কিছু লোক ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করে এবং মুহূর্তেই ইটপাটকেল ছুড়ে। পরে উক্ত কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের ভিতের রেখে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে ভোট গ্রহন বন্ধ ঘোষণা করেন। বিকাল ৪টা পর্যন্ত সেই কেন্দ্র আর ভোট গ্রহণ হয় নাই। পরবর্তী ফলাফল ঘোষণা করলে দেখা যায়, উক্ত কেন্দ্রে ভোট কাস্ট হয় ১৩২১। নৌকা প্রাথী একাই পেয়েছেন ১১৭৮ ভোট, লাঙ্গল ১১৩, মটর গাড়ি ২৭ ও ডাব ৩ ভোট।
একই ঘটনা ঘটেছে জালালপুর সেন্টারে। সাড়ে ১১টার দিকে নৌকার সমর্থক ও সাধারণ ভোটারদের মধ্যে উত্তেজনা মারামারি ছড়িয়ে পড়ে। মারামারি দোহাই দিয়ে রিটানিং কর্মকতা ভোট কেন্দ্র বন্ধ করে দেন। জালালপুর সেন্টারের ভোটার সুহেল মিয়া জানান, হঠাৎ করে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা লাঠি হাতে নিয়ে সাধারাণ ভোটারদের এলোপাতাড়ি মারতে থাকে। ভোটারদের ধাওয়া দিয়ে সেন্টার থেকে বাহির করে দেয়। পরে হ্যান্ড মাইক নিয়ে নির্বাচন কর্মকর্তা ভোট কেন্দ্র বন্ধের ঘোষণা দেন। ফলাফল ঘোষণা করলে দেখা যায়, উক্ত কেন্দ্রে ভোট কাস্ট হয় ৯৬৯। নৌকা প্রাথী পেয়েছেন ৮০২ ভোট, লাঙ্গল ৯৪, মটর গাড়ি ৬০ ও ডাব ১৩ ভোট।
প্রত্যেক কেন্দ্রের ফলাফল একই রকম। ভোট কেন্দ্র দখল, গোপন কক্ষে ফিঙ্গার রেখে নৌকায় ভোট প্রদান, ইভিএম নষ্ট কাজ করছে না বলে ভোটার দিয়ে ফিরেয়ে দেয়া হয় এবং দিন-দুপুরে যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ভোট ডাকাতি করে।
সিলেট-৩ (দক্ষিণ সুরমা-ফেঞ্চুগঞ্জ-বালাগঞ্জ) আসনে মোট ভোটার সংখ্যা-৩৪৯৮৭৩, মোট ভোট কেন্দ্র সংখ্যা-১৪৯, মোট ভোট কাস্ট-১২০৫৯১। মোট ১৪৯ কেন্দ্রের ফলাফল : মটরগাড়ি-৫১৩৫ ভোট, ডাব-৬৪০ ভোট, লাঙ্গল-২৪৭৫২ ভোট ও নৌকা পেয়েছে ৯০০৬৪ ভোট। সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসকের কক্ষে নির্বাচনী কর্মকর্তা, প্রশাসন ও পুলিশের সহযোগীতায় হাবিবুর রহমান হাবিব কে সংসদ সদস্য হিসেবে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।