• ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ১৯শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

জীবন্ত কিংবদন্তী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল হক

Daily Jugabheri
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ৬, ২০২৩
জীবন্ত কিংবদন্তী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল হক

: এম এ মালেক :
‘‘মোরা একটি ফুলকে বাচাঁবো বলে যুদ্ধ করি, মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি……’’ ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে তৈরি করা হৃদয় ছোঁয়া এই গানটির প্রতিফলন আজকের আমাদের এই লাল সবুজের দেশ স্বাধীন বাংলাদেশ। ৭১ সালের বীর সেনানীদের অবদান কখনো ভুলার নয়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তি সেনারা দীর্ঘ ৯ মাসের মরণপণ যুদ্ধ শেষে আমাদের দিয়েছেন মাতৃভুমি বাংলা। সেই মাতৃভুমি বাংলায় জন্ম নেওয়া এক বীর সেনা মুক্তিযোদ্ধা মো. রফিকুল হক।
দেশ স্বাধীনের পূর্বে ১৯৪৬ ইং সালের ৩০ জুলাই দক্ষিণ সুরমার কদমতলী গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন তিনি। মরহুম তবারক আলী ও মাতা মরহুমা রুফেজা খানমের ৪ পুত্র সন্তানের মধ্যে সবার ছোট ছেলে তিনি। মুক্তিযোদ্ধা মো. রফিকুল হকের বড় ভাই মরহুম মোহাম্মদ আলী কছির মিয়া ছিলেন সাবেক কন্ট্রাকটর, অপর ভাই মরহুম মহরম আলী ও শফিকুর রহমান। ৪ ভাইদের মধ্যে দুজন জীবিত থাকলেও অপর দুজন এ পৃথিবীতে নেই। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মো. রফিকুল হকের বড় ভাই মোহাম্মদ আলী কছির মিয়া ও মহরম আলী। এ দুজনকে সিলেটের খাদিমে থাকা পাক সেনাদের ক্যাম্পে ১৯ দিন আটক রেখে নির্যাতনের স্টিম রোলার চালায় পাক হানাদার বাহিনী ।
মো. রফিকুল হক নিজের ভাইদের উপর পাক হায়নাদের বর্বরতার কাহিনী বলতে গিয়ে তাঁর চোখে চলে আসে জল। একান্ত আলাপচারিতায় মুক্তিযোদ্ধা মো. রফিকুল হক বলেন, ১৯৭১ সালে সিলেট ও ভারতের সিমান্তবর্তী সুতারকান্দি বর্ডার হয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্য গেরিলা ট্রেনিং গ্রহনে ভারত চলে যান। ভারত থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত হয়ে তিনি সরাসরি ৪ নং সেক্টরের অধিনে বড়লেখা সীমান্ত হয়ে দেশে প্রবেশ করেন। তিনি একজন সংক্রীয় মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।

শিক্ষাগত যোগ্যতা : মুক্তিযোদ্ধা মো. রফিকুল হকের শিক্ষা জীবন শুরু হয় গোটাটিকর প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ঝালোপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। পরে সিলেটের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজা জিসি হাই স্কুল থেকে ১৯৬৬ ইং সালে এসএসসি পাস করেন। পরে সিলেট মদন মোহন কলেজ থেকে ১৯৬৮ ইং সালে এইচ এস সি পাস করার পর বি কম পড়া অবস্থায় তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে চলে যান।

রাজনৈতিক জীবন : ১৯৬৪ ইং সালে এমসি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের পদচারণা শুরু। তৎকালীন সময়ে তিনি সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সদস্য ছিলেন। ১৯৬৭/৬৮ ইং সালে মদন মোহন কলেজ ছাত্র সংসদের ক্রীড়া সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৬৯/৭০ ইং সালে তিনি মদন মোহন কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস (সাধারণ সম্পাদক) ছিলেন। সেই সময় জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতির পদে থেকে ছাত্র রাজনীতির তুখোড় এক নেতা ছিলেন তিনি। ৬ ও ১১ দফা আন্দোলনের সংক্রীয় কর্মী ছিলেন তিনি। ১৯৭০ ইং সালে পাকিস্থানের জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনে এম এন এ (মেম্মার অব ন্যাশনাল এ্যাসেমব্লেী) ও প্রাদেশিক নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রয়াত মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী ও ডা.কাজী সিরাজের পক্ষে নৌকা প্রতিক নিয়ে ব্যাপক প্রচার প্রচারণার পাশাপাশি তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। ১৯৭১ ইং সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বিএলএফ(বেঙ্গল লিবারেশন ফোর্স) মুজিব বাহিনীর প্রথম গ্রুপের ট্রেনিং এর প্রথম সারীর যোদ্ধা হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেন।
যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তিনি ১৯৭৭ ইং সালে আয়কর আইনজীবি হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের প্রতিষ্টালগ্নে আহবায়ক কমিটির সদস্য ও পরবর্তীতে দীর্ঘ ১৬ বছর জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদকের পদে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত থাকার পাশাপাশি হযঃ দরিয়া শাহ (রাঃ) মাজার জামে মসজিদের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম ও দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে ঐ মসজিদের মোতায়াল্লীর দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিনি একজন সালিশ ব্যক্তিত্ব হিসেবে বর্তমানে পূরো সিলেটে পরিচিত।

সামাজিক আন্দোলন : মুক্তিযোদ্ধা মো. রফিকুল হক দক্ষিণ সুরমা উপজেলা বাস্তবায়ন আন্দোলন কমিটির আহবায়ক ছিলেন এ ছাড়া সিলেট বিভাগীয় সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠার আন্দোলন কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, এ ছাড়া তিনি আরো সেবামূলক সামাজিক সংগঠনের নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনের সাথেও জড়িত থেকে আজ অবধি কাজ করে যাচ্ছেন।

সাংসারিক জীবন : ১৯৮১ ইং সালের ১২ ফেব্রুয়ারী মৌলভীবাজার সদর থানার বাণীশ্রী গ্রামের আমিনা খাতুন রোকেয়ার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ২ পুত্র সন্তান ও ১ কন্যা সন্তানের জনক তিনি। মুক্তিযোদ্ধা মো. রফিকুল হকের বড় ছেলে বিএ পাস করার পরপরই যুক্তরাজ্য চলে যান। বর্তমানে সেখানেই বসবাস করছেন তিনি। মেয়ে রোকশানা হক শোভা আইএ পাস করার পর তার বিয়ে হয়ে গেলে তিনি স্বামীসহ যুক্তরাজ্য অবস্থান করছেন। সব ছোট ছেলে নূরুল হক স্বপন এমএ (ইকোনোমিক্স) পাস করার পর বর্তমানে ব্যবসার সাথে জড়িত।

লেখক ; এম এ মালেক
সিনিয়র রিপোর্টার : দৈনিক যুগভেরী
সদস্য ও সাবেক তথ্য প্রযুক্তি সম্পাদক : সিলেট জেলা প্রেসক্লাব।

সংবাদটি শেয়ার করুন