যুগভেরী ডেস্ক :::
সত্যজিত রায়ের অপু আর ফেলুদা চরিত্রকে রুপালী পর্দায় অমর করে দিয়ে চিরবিদায় নিলেন পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
কলকাতার বেলভিউ ক্লিনিকের বিপণন কর্মকর্তা তুষার অনন্য কান্তি বিশ্বাস জানান, চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার দুপুরে মৃত্যু হয় এই অভিনেতার।
অনেকের বিচারে ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম সেরা এই অভিনেতার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।
খবর পেয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছুটে যান হাসপাতালে। সৌমিত্রের মেয়ে পৌলমীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি সাংবাদিকদের সামনে আসেন।
পৌলমী বলেন, তার বাবার মরদেহ প্রথমে গল্ফগ্রিনের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে। পরে নিয়ে যাওয়া হবে রবীন্দ্র সদনে। কেওড়াতলা শ্মশানে হবে শেষকৃত্য।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ফাইল ছবিসৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ফাইল ছবিকরোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ায় গত ৬ অক্টোবর হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল সৌমিত্রকে। প্রায় দশ দিন চিকিৎসার পর ১৬ অক্টোবর তার করোনাভাইরাস রিপোর্ট ‘নেগেটিভ’ আসে, শারীরিক অবস্থারও কিছুটা উন্নতি হয়।কিন্তু অন্যান্য স্বাস্থ্য জটিলতা থাকায় তার অবস্থার আবার অবনতি হতে শুরু করে। প্রস্টেটের পুরনো ক্যান্সারও আবার ফিরে আসে, সেই সঙ্গে ছিল শ্বাসতন্ত্রের পুরনো সমস্যা।
তিন দিন আগে সৌমিত্রর শ্বাসনালীতে অস্ত্রোপচার করেছিলেন চিকিৎসকরা। এর মাঝেই শুক্রবার থেকে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে।
লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় সৌমিত্রর দেহ চিকিৎসায় আর সেভাবে সাড়া না দেওয়ায় অনেকটাই হাল ছেড়ে দেন চিকিৎসকরা।
একজন চিকিৎসক শনিবার সাংবাদিকদের বলেন, “এখান থেকে ভালো কিছু ঘটার সম্ভাবনা খুব কম। আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছি, এখন কেবল অলৌকিক কিছুই পারে তাকে এ অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনতে।”
কিন্তু সেই অলৌকিক ঘটনাটি আর ঘটল না, বাংলা চলচ্চিত্রের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র যাত্রা করলেন অন্যলোকে।
১৯৩৫ সালে ১৯ জানুয়ারি নদীয়ার কৃষ্ণনগরে এক সাংস্কৃতিক পরিবারে তার জন্ম। বাবা মোহিত কুমার চট্টোপাধ্যায় একজন আইনজীবী ও মঞ্চঅভিনেতা। মা আশালতা চট্টোপাধ্যায়ও যুক্ত ছিলেন মঞ্চনাটকে; তিনি স্থানীয় নাটকের দল ‘প্রতিকৃতি’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন।
সৌমিত্রর স্কুলজীবন কেটেছে কৃষ্ণনগরের সেন্ট জোনস বিদ্যালয়ে। কলকাতা সিটি কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর করার ফাঁকেই নির্দেশক অহীন্দ্র চৌধুরীর হাত ধরে মঞ্চনাটকে তার অভিষেক।
উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘কিং লেয়ার’ অবলম্বনে সুমন মুখোপাধ্যায়ের ‘রাজা লিয়র’ নাটকে নাম ভূমিকায় অভিনয় করে দারুণ প্রশংসিত হন সৌমিত্র। অনেকের বিচারে সেটাই ছিল মঞ্চে তার সেরা অভিনয়।
শুরুতে আবৃত্তি ও মঞ্চনাটকে ব্যস্ত সৌমিত্র চলচ্চিত্র নিয়ে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। তবে সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ তার মন বদলে দেয়।
অপু ট্রিলজির দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘অপরাজিত’র অপু চরিত্রের জন্য অভিনয়শিল্পী খুঁজছিলেন সত্যজিৎ রায়। আর সত্যজিতের সহকারী নিত্যানন্দ দত্তের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল সৌমিত্রর।
সেই সূত্রে অডিশন দিতে গেলেও চরিত্রের সঙ্গে বয়সের তারতম্যের কারণে সেবার সুযোগ মেলেনি তার। তবে সৌমিত্রকে মনে ধরেছিল সত্যজিতের। ১৯৫৯ সালে অপু ট্রিলজির শেষ চলচ্চিত্র ‘অপুর সংসার’ এ তরুণ অপুর চরিত্রে সৌমিত্রকেই তিনি বেছে নেন।
সেই সিনেমায় সৌমিত্রের সঙ্গে অভিষেক ঘটে ১৩ বছর বয়সী শর্মিলা ঠাকুরের। সিগারেটের প্যাকেটে লেখা ‘খাওয়ার পর একটা করে, কথা দিয়েছ’র মতো দৃশ্য আর সৌমিত্র-শর্মিলা জুটির সেই রসায়ন দর্শকের মনে এখনও অমলিন।
সত্যজিতের ৩৪টি সিনেমার মধ্যে ১৪টিতেই অভিনয় করেছেন সৌমিত্র। অপুর পর সত্যজিতের সৃষ্টি আরেক চরিত্র ফেলুদাকে সিনেমার পর্দায় সৌমিত্র নিয়ে গেছেন অন্য মাত্রায়।
ছয় দশকের ক্যারিয়ারে তিনশর বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন এই শিল্পী। মৃণাল সেন, তপন সিনহা, তরুণ মজুমদার, গৌতম ঘোষ, ঋতুপর্ণ ঘোষ, অপর্ণা সেনদের সঙ্গেও কাজ করেছেন।
সাত পাকে বাঁধা, চারুলতা, বাক্স বদল, আকাশ কুসুম, মণিহার, কাঁচ কাটা হীরে, ঝিন্দের বন্দী, অরণ্যের দিনরাত্রি, সোনার কেল্লা, জয় বাবা ফেলুনাথ, হীরক রাজার দেশে, ঘরে বাইরে, আবার অরণ্যের মত সিনেমার মধ্য দিয়ে সৌমিত্র স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন দর্শকের হৃদয়ে।
অভিনয় ছাড়াও নাটক ও কবিতা লিখেছেন তিনি, যুক্ত হয়েছেন মঞ্চ নাটকের নির্দেশনায়, দ্যুতি ছড়িয়েছেন আবৃত্তির মঞ্চেও।
চলচ্চিত্রে ভারতের সর্বোচ্চ সম্মাননা দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার ছাড়াও ফ্রান্স সরকারের ‘লিজিয়ন অব দ্য অনার’ পদকে ভূষিত হয়েছেন এই অভিনেতা। ২০০৪ সালে তাকে ‘পদ্মভূষণ’ খেতাবে ভূষিত করে ভারত সরকার।
ধর্মের নামে গোঁড়ামি ও বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার (মার্কসবাদী) সমর্থক ছিলেন, তিনি ছিলেন বিজেপি সরকারের কড়া সমালোচকদের একজন।
দুর্গা পূজার সময় তিনি হাসপাতালে থাকা অবস্থায় সিপিএম এর মুখপত্রের শারদ সংখ্যায় তার শেষ লেখাটি প্রকাশিত হয়।
সেখানে সৌমিত্র লেখেন, বামপন্থীদের নিয়ে সংশয় থাকলেও এখনও বামপন্থাকেই বিকল্প হিসেবে দেখেন তিনি।
সিপিআইএম-এর নেতা, ভারতের ইতিহাসের দীর্ঘমেয়াদে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলানো জ্যোতি বসুর সঙ্গেও সখ্য ছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের; ছেলেবেলায় কাকার হাত ধরে জ্যোতি বসুর বিভিন্ন সভায় হাজির হওয়ার স্মৃতি বিভিন্ন লেখায় তিনি তুলে ধরেছেন।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী দীপা চট্টোপাধ্যায়ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে জড়িয়ে আছেন। তাদের ছেলে সৌগত চট্টোপাধ্যায় একজন কবি; আর মেয়ে পৌলমী বসুর ছেলে রণদীপ বসু টালিগঞ্জের উদীয়মান অভিনেতাদের একজন।